দুই বছর ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন আটকে রাখা মানবাধিকার লঙ্ঘন

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) রওশন আরা নামের এক নারীর কিডনি গায়েব করে দেওয়ায় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অকেজো হয়ে মারা যান তিনি। ঘটনাটি ঘটে ২০১৮ সালের ৫ সেপ্টেম্বর।
অথচ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (ঢামেক) ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ থেকে দুই বছর পর লাশের ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পায় ভুক্তভোগীর পরিবার। আর এই ঘটনায় মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে বলে জানিয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন গঠিত তদন্ত কমিটির একটি প্রতিনিধিদল ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন দেরির কারণ জানতে আজ বৃহস্পতিবার ঢামেকের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগে যান।
সে সময় তদন্তদলের প্রধান ও মানবাধিকার কমিশনের পরিচালক (অভিযোগ ও তদন্ত) আল-মাহমুদ ফায়জুল কবীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের এ কথা জানান।
আল-মাহমুদ ফায়জুল কবীর বলেন, ‘এখানে (ফরেনসিক বিভাগে) আগের সিরিয়ালের রিপোর্টগুলো না দিয়ে যদি দুই-তিন বছরের পরের সিরিয়ালের রিপোর্টগুলো আগে দেওয়া হয়, তাহলে এখানে কী হয় না হয় বোঝাই যাচ্ছে।
এটা অবশ্যই মানবাধিকার লঙ্ঘন। কারণ, প্রতিটা সরকারি কাজের রিপোর্ট, প্রতিবেদন বা চিঠি যথা সময়ে পাওয়ার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের আছে। রিপোর্টটি যথা সময়ে না হয়ে দুই বছর বিলম্বিত হওয়ায় অবশ্যই মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। এটার জন্য সংশ্লিষ্ট শাহবাগ থানা নাকি এই ফরেনসিক বিভাগ দায়ী তা আমরা খতিয়ে দেখব।’
তবে রিপোর্ট দিতে কেন দেরি হয়েছে তার একটি ব্যাখ্যা দিয়েছে ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘পোস্টমর্টেম করার পর আমরা হিস্ট্রোপ্যাথলজির জন্য অপেক্ষা করি এবং ভিসেরার কেমিকেল সংরক্ষণ (প্রিজার্ভ) করি।
আমরা সেই হিস্ট্রোপ্যাথলজির রিপোর্টের জন্য এক বছর অপেক্ষা করি। এক বছর পর যদি আমি হিস্ট্রোপ্যাথলজিক্যাল রিপোর্ট পাই, তাহলে অটোমেটিক্যালি রিপোর্ট দিতে আমার এক বছরের চেয়ে বেশি সময় লাগবে। রিপোর্ট দিতে দেরি হওয়ার সেটি একটি কারণ হতে পারে।’
‘ময়নাতদন্তের রিপোর্টের জন্য পুলিশ এসেও আমার কাছে বলেনি। অথবা পুলিশ রিপোর্ট নিতে চায়নি বিধায় এটা আমরা লিখে রেখেছিলাম। কয়েকদিন পর পুলিশ আসছে, তারপরও পুলিশের কিছুদিন দেরি হয়েছে।’ যোগ করেন ডা. সোহেল মাহমুদ।
গত বছরের নভেম্বরের শুরুর দিকে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পাওয়ার পর ২৬ নভেম্বর রাতে চলচ্চিত্র পরিচালক মো. রফিক শিকদার বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলায় আসামি করা হয়েছে বিএসএমএমইউর ইউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. হাবিবুর রহমান দুলাল (৫৫), সহকারী অধ্যাপক মো. ফারুক হোসেন (৪৮), চিকিৎসক মো. মোস্তফা কামাল (৪৬) ও চিকিৎসক আল মামুনকে (৩৩)।
রফিক শিকদার গত ২৮ নভেম্বর এনটিভি অনলাইনের কাছে দাবি করেন, ২০১৮ সালের ৫ সেপ্টেম্বর হাসপাতালটির ইউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. হাবিবুর রহমান দুলাল, সহকারী অধ্যাপক ডা. ফারুক হোসেন, মেডিকেল অফিসার আল মামুন ও তৎকালীন রেসিডেন্স (শিক্ষার্থী) ডা. মোস্তফা কামাল মিলে রওশন আরার বাঁ পাশের কিডনি অপসারণ করতে অস্ত্রোপচার করেন। কথা ছিল বাঁ পাশের কিডনি ফেলে দেবেন। বাঁ পাশের কিডনি ফেলার সঙ্গে সঙ্গে তারা ডান পাশের কিডনিটাও গায়েব করে দেন।
রফিক শিকদারের দাবি, ‘এসব ঘটনা নিয়ে একের পর এক গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হওয়ার পর ওই বছরের ১ অক্টোবর অধ্যাপক ডা. হাবিবুর রহমান দুলাল চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতিতে গিয়ে আমার সঙ্গে একটি চুক্তিনামা করেন।
তিনি আমার মায়ের ডান পাশের কিডনি অপসারণের দায় স্বীকার করে নেন। এবং তিনি বিনামূল্যে কিডনি প্রতিস্থাপন করে দেবেন বলেও আমাকে জানান। কিন্তু এই বিষয়ে পরে তিনি আর কখনো খোঁজখবর নেননি।’
যদিও সে সময় নিজের খালার কাছ থেকে কিডনি সংগ্রহ করেছিলেন দাবি করে রফিক শিকদার বলেন, ‘অপারেশনের পর মায়ের শরীরে দুটি কিডনিই না থাকায় তাঁর শরীর বিকল হতে শুরু করে। ২০১৮ সালের ৩১ অক্টোবর বিএসএমএমইউতে আমার মা মারা যান।
এরপর শাহবাগ থানায় আমি একাধিকবার মামলা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মামলা নেওয়া হয়নি। বলা হয়েছিল, ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন না পেলে মামলা নেওয়া হবে না। কিন্তু দুই বছরেও আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগ থেকে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পাইনি।
নানা সময়ে ওই বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ আমাকে বিভিন্নভাবে হয়রানি করে সময়ক্ষেপণ করিয়েছেন। সম্প্রতি আমি তাঁর বিরুদ্ধে হাইকোর্টে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানালে তিনি চলতি মাসের শুরুর দিকে শাহবাগ থানায় ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পাঠান।’
‘ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আমার মায়ের শরীরে কোনো কিডনি ছিল না। বিষয়টি প্রমাণিত। রিপোর্ট পাওয়ার পর আমি শাহবাগ থানায় মামলা করতে গেলে প্রথমে থানা কর্তৃপক্ষ মামলা নিতে অস্বীকার করে। পরবর্তীতে অনেক চেষ্টা করে মামলা দায়ের করেছি’, যোগ করেন রফিক শিকদার।
এ বিষয়ে শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মামুন অর রশিদ এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমি থানায় যোগদান করেছি মাত্র তিন মাস। আগে কেন মামলা নেওয়া হয়নি, তা আমি জানি না। আমি মামলা নিয়েছি। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে। তবে এখনো কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি।’
অভিযোগের বিষয়ে অধ্যাপক ডা. মো. হাবিবুর রহমান দুলাল ও একই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. ফারুক হোসেনের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাদের মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনের দেরি প্রসঙ্গে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান সোহেল মাহমুদ বিকেলে এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমরা বোধহয় রিপোর্টটি আরো আগেই হাসপাতালে জমা দিয়েছি। তারপর পুলিশের কাছে দিয়েছি। ভুক্তভোগীর রিপোর্টটি পেতে বোধহয় সেজন্য দেরি হয়েছে।’
এ সময় সোহেল মাহমুদ আরো জানান, এই ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনের ব্যাপারে কেউ তাঁকে মামলার কোনো হুমকি দেননি।
কিডনি গায়েবের ঘটনা যখন ঘটেছিল তখন ইউরোলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ছিলেন অধ্যাপক ডা. মো. সাজিদ হাসান। তিনি বলেন, ‘আমার যতটুকু মনে পড়ে ঘটনার সময় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটি অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটি করেছিল।
কারণ, ঘটনাটি হাসপাতালেই বেশ আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল। তবে তদন্ত প্রতিবেদনে কী বলা হয়েছিল, তা আমি জানি না। তবে এ রকম একটি ঘটনার ময়নাতদন্ত করতে দুই বছর বা তার বেশি সময় লাগার ঘটনা স্বাভাবিক নয়।’
বর্তমানে ইউরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এ কে এম খুরশিদ আলম। তিনি এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘যেহেতু একটি মামলা হয়েছে সেহেতু আপাতত বিষয়টি নিয়ে কথা বলা ঠিক হবে না। এই বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছিল।
তারা একটি তদন্ত প্রতিবেদনও দিয়েছিলেন। ওই ঘটনার পর আর কোনো কিছু শুনিনি। আমি ভেবেছিলাম সব বোধহয় ঠিক হয়ে গেছে। কিন্তু ময়নাতদন্তের রিপোর্ট আসার পর দেখলাম, আবার এসব নিয়ে কথা শুরু হয়েছে। যাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে তাঁরা এখনো দায়িত্ব পালন করছেন।’