বি’ক্রি করে দিয়েছিলেন চাচা-চাচি, ১২ বছর পর ফিরে পেলেন বাবা-মাকে

এক যুগ পর নোয়াখালীর সেনবাগে ডুমুরুয়াতে বাবা মায়ের দেখা পেলেন নাছিমা আক্তার জোসনা। দীর্ঘ একযুগ পর হারিয়ে যাওয়া আদরের সন্তানকে পেয়ে পরিবারে আনন্দের ব’ন্যা বইছে। প্রতিদিন এলাকার মানুষজনও দেখতে আসছেন
জোসনাকে। কিন্তু জোসনা শারীরিক ও মানসিকভাবে অনেকটা বিপর্যস্ত, ক্লান্ত। তার জীবনের ক’ষ্টের গল্প শুনে কাঁদছেন সবাই। জোসনা পরিবারকে জানিয়েছেন, দুই লাখ টাকায় তাকে এক আত্মীয়ের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলেন তার চাচা-চাচি।
পরিবার ও কয়েকজন গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নোয়াখালীর সেনবাগ উপজে’লার ৩ নম্বর ডমুরুয়া ইউনিয়নের পরীকোট গ্রামের আবদুল মালেকের প্রথম সংসারের বড় মে’য়ে ছিল নাছিমা আক্তার জোসনা। ২০০৮ সালে
১৫ জুলাই ১১ বছর বয়সী বড় মে’য়ে জোসনাকে রেখে দ্বিতীয় সংসারের মা ও অন্যান্য ভাইবোনরা বৈশাখী মেলায় যান। মেলা থেকে সবাই ফিরে এসে তাকে ঘরে দেখতে না পেয়ে অনেক খোজাঁখুজি করেন। ওই সময়ে জোসনার চাচা, চাচি ও
চাচাতো ভাই জানান, ইটভাটার শ্রমিকদের সঙ্গে তাকে তারা চলে যেতে দেখেছেন। তখন বাড়ির পাশ্ববর্তী ইটভাটা থেকে স’ন্দেহভাজন দুজন নিরপরাধ শ্রমিককে ধরে এনে বেদম মা’রধর করা হলেও জোসনাকে আর পাওয়া যায়নি।
এত বছর পর মে’য়েকে ফিরে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা বাবা আবদুল মালেক। তিনি জানান, মে’য়ে নি’খোঁজ হওয়ার পর অনেক জায়গায় খুঁজেছেন। এলাকার হুজুর থেকে শুরু করে যে যেখানে যেতে বলেছেন, মে’য়েকে পাওয়ার জন্য সেখানে গিয়েছেন। অনেক টাকাও খরচ করেছেন এসব পথে। কিন্তু মে’য়েকে পাওয়া যায়নি। থা’না পু’লিশে গিয়ে কোনো লাভ
হবে না ভেবে থা’নায়ও যাননি। তবে সময় সময় মে’য়ে ফিরে আসবে এ আশায় মনকে সান্ত্বনা দিয়েছেন। জোসনার মা
(দ্বিতীয় পক্ষের) জহুরা বেগম বলেন, ‘তিনি জোসনাকে গর্ভে ধারণ না করলেও সে তার অন্যান্য ছে’লেমে’য়ের মতো ছিল। একসঙ্গে তার মে’য়ের সঙ্গে পঞ্চ’ম শ্রেণিতে লেখাপড়া করত। মেলা থেকে এসে মে’য়েকে না পেয়ে অনেক জায়গায় খুঁজেছি কিন্তু কোথায় পাইনি। এর মধ্যে জোসনার চাচিসহ প্রতিবেশীরা তকে নানা ধরনের অ’পবাদ দিয়েছে। মানুষের দেয়া সব অ’পবাদ মুখবন্ধ করে সহ্য করেছি।’
গত গত ৫ নভেম্বর নিজ বাড়িতে ফিরে আসতে সক্ষম নাছিমা আক্তার জোসনা। মে’য়েকে দেখে বাবা-মা প্রথম বিশ্বা’স করতে পারেননি ১১ বছর বয়সে হারিয়ে যাওয়া এটি তাদের আদরের জোসনা। পরে জোসনা সব খুলে বলেন। এক যুগ পর
বাবা-মা, ভাই-বোনদের কাছে ফিরে আসতে পেরে খুশির শেষ নেই জোসনার। শোনান তার এতদিন নি’খোঁজ থাকার গল্প। কা’ন্নাজ’ড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আমি জীবনেও ভাবতে পারিনি আবার আমা’র পরিবারের লোকজনদের কাছে ফিরে আসতে পারব। কারণ আমা’র চাচা, চাচি ও চাচাতো ভাই আমাকে ফুসলিয়ে ১২ বছর আগে তাদের এক আত্মীয়ের
বাড়িতে নিয়ে যান। আমি তখন যেতে চাইনি। তারা বলেছিলেন, তোর মা, ভাই, বোনরা বাড়িতে আসার আগেই আম’রা ফিরে আসব। পরে তাদের আত্মীয়ের বাড়ি থেকে আমাকে গাড়িতে উঠিয়ে ফেনীতে এক বাসায় নিয়ে যান। সেখানে আমাকে রেখে তারা চলে আসেন।’
‘মাঝেমধ্যে চাচি ওই বাসায় গেলে আমি আসতে চাইলে আমাকে মা’রধর করা হতো। বাসার লোকজন বলতেন, তারা (চাচা-চাচি) আমাকে তাদের কাছে দুই লাখ টাকার বিনিময়ে বেচে দিয়েছেন। আরও বলতেন, মাসে মাসে তোর চাচিকে টাকা দিই। বাসায় সব দারোয়ান ও সিসি ক্যামেরা ছিল। ওখান থেকে বের হয়ে আসার কোনো সুযোগ ছিল না। তারা
সেখানে আমাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নি’র্যাতন করতেন।’ ‘আবার আমা’র চাচির প্র’রোচনায় তারা আমাকে ওই বাসার কাজের ছে’লের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেন। বিয়ে দেয়ার সময় আমা’র চাচা, চাচি ভু’য়া একটি জন্মসনদ দেন। সে
কাগজ থেকে আমি আমা’র গ্রামের ঠিকানা জানতে পারি এবং অনেক খোঁজাখুঁজি করে অবশেষে আমি আমা’র জন্ম’দাতা বাবা, মা ও ভাইবোনদের কাছে আসতে পারি’-কথাগুলো বলে যান জোসনা।
জোসনার পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ ঘটনা জানাজানি হয়ে পড়লে স্থানীয়ভাবে বিষয়টি সমাধানের জন্য বৈঠক ডা’কা হয়। বৈঠকে চাচা ইদ্রিস মিয়া ও চাচি আফরোজা বেগম তাদের দোষ স্বীকার করেন এবং জোসনার
ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তার নামে ১২ শতক জায়গা দেয়ার অঙ্গীকার করেন। কিন্তু পরে তা অস্বীকার করে উল্টো গ্রাম সালিশদার ও জোসনার পরিবারের সদস্যদের নামে সেনবাগ থা’নায় একটি মা’মলা দায়ের করেন। স্থানীয় ডুমুরুয়া
ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাখাওয়া হোসেন বলেন, এ অমানবিক ঘটনার সঙ্গে জ’ড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শা’স্তি হওয়া উচিত। পরিষদের ভু’য়া জন্মসনদ ব্যবহারকারীদের বি’রুদ্ধে প্রয়োজনী ব্যবস্থা গ্রহণেরও আশ্বা’স দেন তিনি।
নোয়াখালী জজ কোর্টের আইনজীবী সামছুল আলম শাফী জানান, পাচারের শিকার নাছিমা আক্তার জোসনা নিজ চাচা, চাচি ও চাচাতো ভাইসহ আরও কয়েকজনকে আ’সামি করে গত ১৭ নভেম্বর একট মা’মলা দায়ের করেছেন। মা’মলা’টি পু’লিশ ব্যুরো অব ইনভিস্টিগেশনকে (পিবিআই) ত’দন্তের দায়িত্ব দিয়েছেন আ’দালত।
নোয়াখালী পু’লিশ সুপার মো. আলমগীর হোসেন বলেন, ‘ঘটনাটি নিয়ে সেনবাগ থা’নায় ও আ’দালতে পাল্টাপাল্টি
মা’মলা হয়েছে। বিষয়টি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে ত’দন্ত করার জন্য অ’তিরিক্ত পু’লিশ সুপার বেগমগঞ্জ সার্কেল অফিসারকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ত’দন্তে যাদের বি’রুদ্ধে অ’প’রাধ প্রমাণিত হবে তাদেকে আইনের আওতায় আনা হবে।’