খু’নি মাজেদের লা’শ কঠোর গোপনীয়তার সোনারগাঁয়ে দাফন

Apr 12, 2020 / 11:51am
খু’নি মাজেদের লা’শ কঠোর গোপনীয়তার সোনারগাঁয়ে দাফন

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মস্বীকৃত খু’নি ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) আব্দুল মাজেদের ফাঁ’সি কার্যকরের পর তার লা’শ কঠোর গোপনীয়তার মধ্যে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার শম্ভুপুরা ইউনিয়নের হোসেনপুর এলাকায় দা’ফন করা হয়েছে।

মাজেদের শ্বশুর বাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে শনিবার দিবাগত রাত ৩টার দিক তার লা’শ দা’ফন করা হয়েছে বলে স্থানীয় প্রশাসন, শম্ভূপুরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুর রউফ ও একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।

এদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মস্বীকৃত খু’নির লা’শ সোনারগাঁয়ে দাফন করার খবর সকালে বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে সাধারণ মানুষের মধ্যে চরম ক্ষো’ভের সৃষ্টি হয়েছে।

অনেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে সোনারগাঁয়ে মাজেদের লা’শ দা’ফন করায় চরম ক্ষোভ প্রকাশ ও লাশ অপসারণের দাবি জানান।

সোনারগাঁ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড, উপজেলা আওয়ামী লীগ ও স্থানীয় বিভিন্ন রাজনৈতিক সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ খু’নি মাজেদের লা’শ সোনারগাঁয়ে দা’ফন করায় তীব্র নি’ন্দা ও প্রতিবাদ জানান।

অনেকে মাজেদের লা’শ অ’পসারণ না করা হলে তা কবর থেকে তুলে মেঘনা নদীতে ভাসিয়ে দেয়ার ঘোষনা দেন।

ভোলায় তার লা’শ দা’ফনের কথা থাকলেও শনিবার বিকালে লালমোহন উপজেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এমপি শাওন বলেন, খু’নি মাজেদের লা’শ ভোলাবাসী গ্রহণ করবে না। তার লাশ প্রয়োজনে বঙ্গপোসাগরে ভাসিয়ে দিতে বলেন এমপি শাওন।

রোববার প্রথম প্রহরে (রাত ১২টা এক মিনিট) ঢাকা কেন্দ্রীয় কারা’গারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মস্বীকৃত খু’নি মৃ’ত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) আবদুল মাজেদকে (৭২) ফাঁ’সিতে ঝু’লিয়ে মৃ’ত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

বঙ্গবন্ধুকে হ’ত্যার ৪৪ বছর ৭ মাস ২৬ দিন পর খু’নি মাজেদের ফাঁ’সি হয়। এতে শাহজাহানের নেতৃত্বে মনির ও সিরাজ জ’ল্লাদ হিসেবে কাজ করেছে। বঙ্গবন্ধুর ঘা’তকদের মধ্যে এখন পর্যন্ত মোট ৬ জনের সা’জা কার্যকর হল। প’লাতক আছে আরও ৫ খু’নি। দ’ণ্ড মাথায় নিয়ে এক খু’নি বিদেশেই মা’রা গেছে। আদালত ১২ জনের মৃ’ত্যুদণ্ড দেন।

শনিবার দুপুরের পর থেকে রায় কার্যকরের প্রক্রিয়া শুরু হয়। মাজেদকে জানিয়ে দেয়া হয় তার সাজার বিষয়। কারা চিকিৎসক খু’নি মাজেদের শারীরিক অবস্থা পরীক্ষা করেন।

কয়েকবারই তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা হয়। রাতে মাজেদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তার স্ত্রী সালেহা বেগম, সালেহার বোন ও ভাইয়ের ছেলে। এ সময় তারা কারা প্রকোষ্ঠেই কিছু সময় কাটান। বেরিয়ে আসার সময় স্ত্রী সাহেলাকে চোখ মুছতে দেখা গেছে।

সন্ধ্যার পরপরই মাজেদকে রাতের খাবার খেতে দেয়া হয়। কারা মসজিদের ইমাম এসে তাকে তওবা পড়ান। এর আগে তাকে গোসল করানো হয়। সব কিছুই শান্ত ও ধীরস্থিরভাবে সম্পন্ন করে মাজেদ। শেষ সময় সে নামাজ আদায় করে।

রাতে ধীর পদক্ষেপে মাজেদ ফাঁ’সির মঞ্চের দিকে এগিয়ে যায়। তবে কারাগারের সেল থেকে বের করার সময় তাকে কিছুটা ভীত দেখা যায় বলে জানিয়েছেন এক প্রত্যক্ষদর্শী। দুই দিক থেকে দু’জন জ’ল্লাদ তাকে মঞ্চের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়।

ফাঁ’সি কার্যকরের সময় ঢাকার জেলা প্রশাসক, এসপি, সিভিল সার্জন, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, আইজি (প্রিজন্স), কারা চিকিৎসকসহ কারা কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। মঞ্চে তোলার পর জল্লাদদের একজন কালো রঙের জমটুপি দিয়ে তার মাথা ও মুখ ঢেকে দেয়। গলায় দড়ি পরিয়ে দেয় অপর জ’ল্লাদ।

এরপর সিনিয়র জেল সুপার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে হাতে রুমাল নিয়ে দাঁড়ান। ঘড়ির কাঁটা নির্ধারিত সময় স্পর্শ করার পর তিনি হাতের রুমাল ফেলে দেন। রুমাল পড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জ’ল্লাদ মঞ্চে হাতল ধরে টান দেয়। দু’ফাঁক হয়ে যায় প্লেট, ঝুলে পড়ে মাজেদের দেহ। কিছুক্ষণ ঝুলিয়ে রাখার পর তার ম’রদেহ ফাঁ’সির মঞ্চ থেকে নামিয়ে আনা হয়। চিকিৎসক তার মৃ’ত্যু নিশ্চিত করেন।

এরপর তার ম’রদেহের ময়নাতদন্ত হয়। মৃতদেহ রাখার জন্য আগেই কফিন এনে রাখা হয়েছিল। সেখান থেকে ক’ফিনে ভরে পরিবারের সদস্যদের কাছে লা’শ হস্তান্তর করেন কারা কর্তৃপক্ষ।

মাজেদের লা’শের গাড়িবহর কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে গ্রামের বাড়ি ভোলার বোরহানউদ্দিনে দা’ফনের উদ্দেশে রওনা দেয়। এর আগে রাত ১১টার মধ্যেই কারাগারে প্রবেশ করেন আইজি (প্রিজন্স),

অতিরিক্ত আইজি (প্রিজন্স), ডিআইজি (প্রিজন্স), সিনিয়র জেল সুপার, ঢাকার সিভিল সার্জন, কা’রাগারের দু’জন সহকারী সার্জন, ঢাকা জেলার পুলিশ সুপারের প্রতিনিধি এবং দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ওসি।

বুধবার রাতে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুর খু’নি মাজেদের প্রাণভি’ক্ষার আবেদন নাকচ করার পর এ সংক্রান্ত একটি চিঠি বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় কা’রাগারে পৌঁছে। এর পর থেকেই মূলত ফাঁ’সি কার্যকরের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়।

শুক্রবার সন্ধ্যায় কারাগারে মাজেদের সঙ্গে তার স্ত্রীসহ পরিবারের ৫ সদস্য দেখা করেন। শনিবার ফাঁ’সির মঞ্চসহ সব কিছুর প্রস্তুতি দফায় দফায় পরীক্ষা করে দেখা হয়।

মঞ্চটি নতুন করে ধুয়েমুছে পরিষ্কার করা হয়। কেরানীগঞ্জে নবনির্মিত ঢাকা কেন্দ্রীয় কা’রাগারে এটিই প্রথম কারো ফাঁসি। কাজেই সেভাবেই সব প্রস্তুতি নেয়া হয়। জ’ল্লাদ কে থাকবে, তাকে সহায়তা কবরে কে কে তাও নির্ধারণ করা হয়।

১০ সদস্যের জ’ল্লাদ দলকে শনিবার দিনের আলোতে একাধিকবার ট্রায়ালও দেয়া হয়। রাত ৮টার দিকে ফাঁ’সির মঞ্চের আশপাশের আলো জ্বা’লিয়ে দেয়া হয়। সেখানে দায়িত্ব পালন করেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। কা’রাগারের আশপাশের নিরাপত্তাও বাড়ানো হয়।

বুধবার ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ এম হেলাল উদ্দিন চৌধুরী খু’নি মাজেদের বিরুদ্ধে মৃ’ত্যুপরোয়ানা জারি করেন। সোমবার রাত ৩টা ৪৫ মিনিটের দিকে গাবতলী বাসস্ট্যান্ডের সামনে থেকে তাকে গ্রে’ফতার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

বঙ্গবন্ধু হ’ত্যা মা’মলা ও বিচার: ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার নির্মমভাবে হ’ত্যা করে একদল বিপথগামী সেনাসদস্য।

ওই সময় বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। না’রকীয় এই হত্যাকাণ্ডের বিচারে পদে পদে বাধা আসে। বঙ্গবন্ধুকে হ’ত্যার পরপরই দায়মুক্তি (ইনডেমনিটি) অধ্যাদেশ জারি করা হয়। ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর দায়মুক্তি আইন বাতিল করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার।

ওই বছরের ২ অক্টোবর ধানমণ্ডি থানায় বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী মহিতুল ইসলাম বাদী হয়ে মা’মলাটি করেন। ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর তৎকালীন ঢাকার দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল ১৫ জনকে মৃ’ত্যুদণ্ডাদেশ দিয়ে রায় দেন।

নিম্ন আদালতের এই রায়ের বি’রুদ্ধে আ’সামিদের আপিল ও মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিতকরণের শুনানি শেষে ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর হাইকোর্ট দ্বিধাবিভক্ত রায় দেন। ২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল হাইকোর্টের তৃতীয় বেঞ্চ ১২ আ’সামির মৃ’ত্যুদণ্ড বহাল রেখে তিনজনকে খালাস দেন। এরপর ১২ আ’সামির মধ্যে প্রথমে চারজন ও পরে এক আসামি আপিল করে। কিন্তু দীর্ঘদিনেও আপিল শুনানি না হওয়ায় বিচার প্রক্রিয়া আ’টকে যায়।

দীর্ঘ ছয় বছর পর বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আপিল বিভাগে একজন বিচারপতি নিয়োগ দেয়ার পর বঙ্গবন্ধু হ’ত্যা মা’মলাটি ফের গতি পায়। ২০০৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. তাফাজ্জাল ইসলামের নেতৃত্বাধীন তিন বিচারপতির বেঞ্চ মৃ’ত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৫ আ’সামির লিভ টু আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করেন।

আপিলের অনুমতির প্রায় দুই বছর পর ২০০৯ সালের অক্টোবরে শুনানি শুরু হয়। ২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ ৫ আ’সামির আপিল খারিজ করেন।

ফলে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের নৃ’শংসভাবে হত্যার দায়ে হাইকোর্টের দেয়া ১২ আ’সামির মৃ’ত্যুদণ্ডাদেশ বহাল থাকে। এভাবে ১৩ বছর ধরে চলা এই মা’মলার বিচার প্রক্রিয়া শেষ হলে দায়মুক্ত হয় বাংলাদেশ।

সুত্রঃ যুগান্তর