আমাদের অন্তর, আমাদের স্বপ্নও ‘লা’শের সঙ্গে দাফন করা হয়েছে’

Apr 3, 2020 / 01:07am
আমাদের অন্তর, আমাদের স্বপ্নও ‘লা’শের সঙ্গে দাফন করা হয়েছে’

গত বুধবার সকালে ক’রো’না’ভা’ইরাসে আ’ক্রা’ন্ত হয়ে এক বৃদ্ধ মা’রা যান। পরে রাজধানীর খিলগাঁওয়ের তালতলা কবরস্থানে তাঁকে দা’ফন করা হয়।

ক’রো’না’ভা’ই’রাসের উপসর্গ জ্বর, কাশি ও শ্বা’স’কষ্ট নিয়ে মৃত্যু হয়েছিল রাবেয়া আক্তারের (৫০)। রাজধানীর মোহাম্মদপুরে নিজ বাড়িতেই গত শুক্রবার মারা যান তিনি।

এরপর থেকেই এলাকায় আতঙ্ক তৈরি হয়। স্থানীয়রা মোহাম্মদপুর থানায় জানান, রাবেয়া ক’রো’না’ভা’ই’রাসে আ’ক্রা’ন্ত হয়ে মা’রা গেছেন। পরে থানা পুলিশ গিয়ে রাবেয়ার লা’শ উ’দ্ধা’র করে।

লা’শ উদ্ধারের পর বিষয়টি সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে (আইইডিসিআর) জানায় মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ। পরে আইইডিসিআর বেলা ১১টার দিকে রাবেয়ার বাড়িতে গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করে।

এরপর আল মার্কাজুল ইসলামী নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করে রাবেয়ার পরিবার। আল মার্কাজুল থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করা হলে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালককে লাশ দাফনের অনুমতি দেওয়া হয়।

আল মার্কাজুল ইসলামী প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআর দ্বারা স্বীকৃত। এখন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে অথবা ক’রো’না সন্দেহে মা’রা যাওয়া ছয় ব্যক্তির লা’শ দাফন করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এই ছয়টি লা’শের মধ্যে চারটি লা’শ খিলগাঁও তালতলা কবরস্থানে দা’ফন করেছে এ স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান।

তালতলা কবরস্থানে যাঁদের দাফন করা হয়েছে, তাঁদের একজন রাবেয়া আক্তার। গত ২৯ মার্চ তাঁকে দাফন করা হয়। বিষয়টি জানান আল মার্কাজুলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হামজা শহিদুল ইসলাম।

লা’শ’টি দাফনের নেতৃত্বে ছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সহকারী সমাজ কল্যাণ কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান। গতকাল বুধবার খিলগাঁওয়ের তালতলা কবরস্থানে বসে তিনি এসব কথা জানিয়েছেন।

আসাদুজ্জামান বলেন, ‘রাবেয়ার স্বামী হারুন উর রশিদের অভিযোগ, রাবেয়ার মা-বাবা, শ্বশুর-শাশুড়ি ও দুই ছেলে-মেয়ে থাকার পরও দা’ফনে শুধু তিনি ও তাঁর এক ছেলে এসেছিলেন। কারণ, আইইডিসিআর থেকে বলা হয়েছে, রাবেয়া ক’রো’নায় মা’রা গেছেন। সেই ভয়ে কেউ লা’শের পাশে আসেনি।’

দাফন করল আইইডিসিআর, অথচ করোনায় মারা যাননি রাবেয়া

গল্পে গল্পে আসাদুজ্জামান বলছিলেন, ‘রাবেয়া আক্তারের স্বামী হারুন বুধবার সকালে এসেছিলেন। এসে দুঃখ প্রকাশ করে গেলেন। এ ছাড়া রাগও ছিল তাঁর মধ্যে। হারুনের অ’ভি’যোগ, তাঁর স্ত্রী ক’রো’নায় আ’ক্রা’ন্ত হয়ে মারা যাননি।

মা’রা গেছেন জ্বর, শ্বা’স’কষ্ট আর কাশিতে। এরপরও তাঁকে এখানে দাফন করা হলো। হারুন বলছিলেন, গত মঙ্গলবার ম’র’দে’হের ম’য়’নাতদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছে আইইডিসিআর।

সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, রাবেয়া আক্তার ক’রো’নায় আ’ক্রা’ন্ত হয়ে মা’রা যাননি, তিনি অন্য রোগে মা’রা গেছেন। এ ছাড়া করোনা সন্দেহে হাবিবুর রহমান (৬০) নামের আরো একজনকে দাফন করা হয়েছে। তারও করোনা পরীক্ষায় নেগেটিভ এসেছে।’

মা’রা গেছেন জ্বর, কাশি আর শ্বাসকষ্টে

রাবেয়ার স্বামী হারুন উর রশিদ গতকাল বুধবার রাতে আক্ষেপ করে এনটিভি অনলাইনকে বলছিলেন, ‘আমার সব শেষ। আমার স্ত্রী মারা গেছে জ্বর-কাশিতে। তারপরও তাঁকে দাফন করা হলো করোনা সন্দেহে। আইইডিসিআরই তদন্ত প্রতিবেদন দিয়ে আমাদের বলেছে, রাবেয়া করোনায় মারা যায়নি। অন্যায়ভাবে তাঁকে অন্য কবরে দাফন করা হয়েছে। নাহলে আমরা তাঁকে আমাদের গ্রামের কবরে অথবা পছন্দের কবরস্থানে দাফন করতাম।’

লাশের সঙ্গে দাফন হয়েছে আমাদের স্বপ্নও

হারুন উর রশিদ বলেন, ‘তালতলা কবরস্থানে আমার স্ত্রীর লাশ দাফন করা হয়নি, দাফন করা হয়েছে আমাদের অন্তর, আমাদের স্বপ্নও। আমার ছেলের খুব ইচ্ছে ছিল, তার মাকে নিজের মতো করে অন্য কবরস্থানে দাফন করবে। আমরা কেউ রাবেয়াকে ভালোভাবে দেখতেও পারিনি। লাশ পলিথিন দিয়ে মুড়িয়ে দেওয়া হয়। শেষ দেখাও দেখতে পারিনি। এখন এসব বললে কি আর আমার স্ত্রীকে ফিরিয়ে দিতে পারবেন? আমার বাচ্চা দুটি ছটফট করছে। আমাদের অনুভূতি বুঝবে কে?’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল লতিফ বলেন, ‘রাবেয়া আক্তার মারা যাওয়ার পর স্থানীয় লোকজন থানায় ফোন দিয়ে ঘটনা জানায়। পরে আমরা আইইডিসিআরে বিষয়টি জানাই। তারা এসে ২৯ মার্চ বেলা ১১টার দিকে লাশের নমুনা সংগ্রহ করে চলে যায়। গতকাল শুনলাম, তার নাকি করোনায় মৃত্যু হয়নি। তিনি জ্বর-কাশিতে মারা গেছেন।’

এই ব্যাপারে জানতে চাইলে আল মার্কাজুল ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হামজা শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘২৮ তারিখ রাতে বোধহয় রাবেয়া আক্তার মারা যান। ২৯ তারিখ সকালে রাবেয়ার এক জামাতা আমাদের অফিসে আসেন। এসে বলেন, আইইডিসিআর থেকে লাশটি দাফন করতে বলা হয়েছে আমাদের। এরপর আমি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের যুগ্ম সচিব সাইফুল্লা হিল আজিমকে বিষয়টি জানাই। তারপর তিনি আমাকে লাশ দাফনের অনুমতি দেন। পরে মোহাম্মদপুরে রাবেয়াদের বাসা থেকে লাশ নিয়ে তালতলা কবরস্থানে দাফন করি। পরে শুনেছি, নমুনা পরীক্ষায় তার করোনা ধরা পড়েনি।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা আজ বৃহস্পতিবার বলেন, ‘করোনা সন্দেহে রাবেয়ার লাশ দাফন করা হয়েছে। পরে দেখা গেছে, তাঁর নমুনা পরীক্ষায় নেগেটিভ এসেছে। এই সমস্যা দ্রুতই কেটে যাবে। এখন আমাদের পরীক্ষার ল্যাব বেড়েছে, আর সঠিক সময়ে তথ্য পেলে এই সমস্যা আর হবে না। দাফনের আগেই যদি পরীক্ষার রিপোর্ট পাওয়া যায়, তাহলে মরদেহের পরিবার নিজেদের ইচ্ছে মতো লাশ দাফন করতে পারবে।’