তাপসকে ওরা হাসপাতালের বেডের সঙ্গে বেঁধে রেখেছিলো

গত ১৮ ফেব্রুয়ারি না ফেরার দেশে চলে গেছেন বাংলা চলচ্চিত্রের শক্তিমান অভিনেতা তাপস পাল। তাঁক এই অকাল প্রয়াণ মেনে নিতে পারেননি ভক্তরা। তাপসের মৃত্যু নিয়ে চলছে নানা গুঞ্জন। অনেকে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করছেন।
এবার তাপস পালের মৃত্যু নিয়ে মুখ খুললেন সহধর্মীনি নন্দিনী পাল। ভারতের প্রভাবশালী গণমাধ্যম আনন্দবাজার নন্দিনীর বক্তব্য নিয়ে দীর্ঘ এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে নদন্দিনী বলেছেন- “সত্যিটা সকলের জানা প্রয়োজন।
তাপস চলে যাওয়ার পর এত রকমের ভুল কথা শুনেছি এবং এখনও শুনে চলেছি যে, কথাগুলো না বললেই নয়। নয়তো, সোহিনী এবং আমার বেঁচে থাকাটাই কষ্টকর হয়ে যাবে। সোহিনী, আমি শুধু শুনেই যাচ্ছি… আর পারছি না আমরা!
সে দিন রাতে তাপস হঠাৎই বমি করে। রাতের খাবারে সে দিন সিদ্ধ চিঁড়ে আর ডিম সেদ্ধ খেয়েছিল। প্রথমে আমি ভেবেছিলাম, অ্যাসিডিটির কারণে বমি হয়েছে। তাই অ্যান্টাসিড খাওয়াই তাপসকে। কিন্তু, বমি কিছুতেই থামছিল না। আমার চিন্তা বাড়তে থাকে।
রাতও বাড়ছিল। মনে হল, এ বার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত। মেয়ের বাড়িওয়ালা সেই সময় আমাকে খুব সাহায্য করেন। ওনার চেষ্টাতেই আমি বান্দ্রার এক হাসপাতালে তাপসকে নিয়ে যাই। মনে মনে ভাবছিলাম, কী আর এমন হবে, হয়তো স্যালাইন দিতে হবে ওকে!
হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর ডাক্তার দেখলেন ওকে। বললেন, তাপসের ‘হাইপোগ্লাইসিমিয়া’ হয়েছে, মানে হঠাৎ করে সুগার কমে গেছে। আমাকে বলা হল, ‘আমরা অক্সিজেন দিচ্ছি। আপনি এই ফর্মটা ফিলআপ করে দিন।’ আমি যখন ওই ফর্মটা ফিলাপ করে হাসপাতালকে দিলাম, ওরা জানালেন, এখুনি ৫০ হাজার টাকা দিতে হবে।
আমি ওদের বললাম, চিকিৎসাটা শুরু হোক। সুস্থ হোক তো মানুষটা। বাড়ি গিয়ে ৫০ হাজার কেন, যা লাগবে তাই দিয়ে দেব। এখন সঙ্গে ৫০ হাজার নেই। আমি তো ওকে নিয়ে জাস্ট বেরিয়ে পড়েছিলাম। অত টাকা নিয়ে বেরোইনি। কিন্তু, আমার কথায় ওরা কান দিতে চাইলেন না। বললেন, ৫০ হাজার টাকা এখুনি দিতে হবে। না হলে…।
শেষমেশ টাকার ব্যবস্থা হল। ওকে তত ক্ষণে আইসিইউতে দিয়েছে। পুনম নামের এক চিকিৎসক এলেন। উনি সরাসরিই জানিয়ে দিলেন, তাপসের কোনও ‘পাস্ট হিস্ট্রি’ জানতে মোটেই আগ্রহী নন। এখন কী হয়েছে সে বিষয়ে আমাকে বলতে বলা হল।
তাপস তখন আমার দিকে তাকিয়ে। জানতে চাইল, ক’টা বাজে? আমি ওকে সময়টা জানিয়ে বললাম, বাইরেই আছি। তুমি ভাল হয়ে যাবে। তোমায় ছেড়ে কোথাও যাব না আমি। আমাকে এর পর জানানো হল, তাপসকে ভেন্টিলেশনে দেওয়া হবে। আমি তো অবাক!
কলকাতায় ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলি। উনি আশ্বস্ত করলেন। বললেন, ‘চিকিৎসার জন্য অনেক সময় ভেন্টিলেশনে দিতে হয়।’ রাজি হলাম।
এর পর ৭ ফেব্রুয়ারি ভেন্টিলেশন থেকে বেরিয়ে এল তাপস। স্পষ্ট মনে আছে, হাসল আমায় দেখে। বলল, বাব্বা এটা তুমি কী করলে? আচ্ছা এই নল কবে খুলবে?
দু’বছর ধরে ওর কিডনির সমস্যা ছিল। কিন্তু, ডায়ালিসিসের প্রয়োজন হত না। এই হাসপাতালে ওর ডায়ালিসিস চালু হয়। আমি সম্মতিও দিয়েছিলাম। প্রচুর অ্যান্টিবায়োটিকও চলছিল সঙ্গে। কয়েক দিনের মধ্যে দেখলাম ওর প্রস্রাব আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হচ্ছে।
আমি নিয়মিত কলকাতার ডাক্তারকে সব জানাচ্ছিলাম। ওর কথা মতো হাসপাতালকে বললাম, এখন যদি তাপসের ক্যাথিটার খুলে দেওয়া যায়। কারণ, ক্যাথিটার থেকেও অনেক সময় সংক্রমণ হয়। কিন্তু, ওরা বিষয়টাকে আমলই দিলেন না। অন্য দিকে, তাপসও স্বাভাবিক হচ্ছে।
খুব খিদে পাচ্ছে ওর। সেটা তো ভালই। হলে হবে কী? ওদের কাছে না কোনও বিস্কুট আছে, না আছে স্যুপ। যত খিদেই পাক, খাবার সেই সাড়ে আটটায় দিচ্ছে। এ সব হাসপাতালকে বলায়, এক নার্স তো আমার মেয়েকে বললেন, ক্যাফেটেরিয়া থেকে খাবার এনে খাওয়াতে! রোগীকে ক্যাফেটেরিয়ার খাবার? মেয়ের সঙ্গে তো ঝামেলাই হয়ে গেল ওই নার্সের।
এ ভাবেই চলছিল। এক দিন গিয়ে দেখি তাপসকে বেঁধে রেখেছে। ঘাবড়ে গিয়েছি ও রকম দেখে! আমায় তাপস বলল, ‘এক ভাবে শুয়ে আছি। একটু উঠে হাঁটতে চেয়েছি। তাই দেখো, ওরা আমাকে বেঁধে রেখেছে।’ খুব কষ্ট হচ্ছিল এ ভাবে ওকে দেখে।
এক জন রোগীর সঙ্গে এ কেমন ব্যবহার! আমি প্রশ্ন করায় আমাকে হাসপাতাল থেকে বলা হল, ‘আমাদের শিফ্টিং চলছে। এখন কোনও এক জন সিস্টার ওকে নজরে রাখতে পারবে না। তাই বেঁধে রাখা হয়েছে। আমি তাপসের হাত-পায়ের বাঁধন খুলে বেড-টা তুলে ওকে বসাই। আচ্ছা, এটুকু ওরা করতে পারতেন না?
১৭ ফেব্রুয়ারি। মেয়েকে বাবা বলল, ‘তুমি আমায় কেন বাড়ি নিয়ে যাচ্ছ না?’মেয়ে কথা দিল বাবাকে, এ বার বাড়ি নিয়ে যাবে। বাবা-মেয়ের আদর হল। আমরা সে দিন মনে মনে ঠিক করেছি, তাপসকে ওখান থেকে বার করে আনব। পরের দিনই যদি ওকে কলকাতা নিয়ে আসা যায়, এ রকমই ভেবেছি। সেই মতো ব্যবস্থাও করেছি।
হঠাৎ সে দিন রাতেই মেয়ের কাছে ফোন, ‘হি ইজ নট রেসপন্ডিং।’
মেয়ে তো শুনেই দেড় ঘন্টার রাস্তা ৪০ মিনিটে আমাকে উড়িয়ে নিয়ে পৌঁছল। তাপসের কাছে গিয়ে ও আমাকে বলল, ‘মা দেখো, বাবা পুরো ঠান্ডা!’
আমাদের বলা হল ‘ইন্টারনাল ব্লিডিং’ হচ্ছে। হিমোগ্লোবিন ৩.৯ হয়ে গেছে। সকালেই দেখে গেছি হিমোগ্লোবিন ৯-এর এর উপরে ছিল। তার রিপোর্ট আজও পাইনি। মেয়ে তখন ওদের বলছে,’বাবাকে ব্লাড দিন আগে।
আমার কনসেন্টের জন্য কেন অপেক্ষা করছেন আপনারা?’
আমি বুঝতে পারছিলাম, হিমোগ্লোবিন যার ৩.৯, যাকে রক্তও দেওয়া হয়নি, তার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হবেই। হলও তাই। আবার ভেন্টিলেশন। আবার অ্যাটাক। তার পর সব শেষ!