রাজাকারের তালিকায় রয়েছে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ বন্ধুর নাম!

রাজশাহীর কুখ্যাত রাজাকারদের নাম আসেনি সরকার ঘোষিত রাজাকারদের তালিকায়। তবে এই তালিকাতে ঠিকই এসেছে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর ও মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সংগঠকদের নাম।
তালিকা প্রকাশের পর থেকেই হতবাক ও ক্ষুব্ধ রাজশাহীর মানুষ।
মঙ্গলবার বিকালে নগরীর সাহেববাজার জিরো পয়েন্টে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট রাজশাহী শাখা।
এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বিভিন্ন সংগঠন এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরাও এই প্রতিবাদ সমাবেশে অংশ নেন।
ভাষাসৈনিক আবুল হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ সমাবেশে অন্যদের বক্তব্য দেন মুক্তিযোদ্ধা রুহুল আমিন প্রামাণিক, কবি আরিফুল হক কুমার, মোস্তাফিজুর রহমান খান আলম, মহিলা পরিষদের সভানেত্রী কল্পনা রায়, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় সহ-সাধারণ সম্পাদক উপাধ্যক্ষ কামরুজ্জামান ও দিলীপ ঘোষ প্রমুখ।
সমাবেশ থেকে বিতর্কিত এই তালিকা প্রত্যাহার করে তালিকা প্রণয়নকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি করেন।
এ দিকে রাজাকারের তালিকাটি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, রাজশাহীতে রাজাকারদের তালিকায় এসেছে স্বাধীনতা যুদ্ধের সংগঠকদের নাম। বাদ যায়নি পাকহানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ দুই সন্তানের বাবা ও খোদ বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচরও। রাজাকার হিসেবে নাম এসেছে একুশে পদকপ্রাপ্ত ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠকের। আছে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক এমপির নামও।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে পড়ার সময়ই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল রাজশাহীর স্বনামখ্যাত আইনজীবী আবদুস সালামের। বঙ্গবন্ধু ও আবদুস সালাম দু’জনই থাকতেন কলকাতার বেকার হোস্টেলে। তখনই ছাত্র মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়েছিলেন আবদুস সালাম। এরপর গড়ে উঠে গভীর বন্ধুত্ব। বঙ্গবন্ধু রাজশাহীতে গেলে ঘনিষ্ঠ বন্ধু সালামের বাড়িতেই উঠতেন।
আবদুস সালামের নাতি অ্যাডভোকেট নুরুজ্জামান বাবু জানান, দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে যতবার রাজশাহীতে এসেছেন, প্রটোকল পরিহার করে উঠতেন বন্ধু আবদুস সালামের সিপাহীপাড়ার বাড়িটিতে। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিধন্য সেই বাড়িটি এখনও আছে আগের মতোই। শুধু আগের মানুষেরা কেউ নেই।
মঙ্গলবার দুপুরে আবদুস সালামের সিপাইপাড়ার সেই বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল নিচতলায় বসে রয়েছেন কেয়ারটেকার। গাছপালায় ঘেরা তিনতলার বিশাল এই বাড়িটিতে এখন কেউ আর থাকেন না। পরিবারের অধিকাংশ সদস্য এখন দেশের বাইরে থাকেন।
আবদুস সালামের নাতি অ্যাডভোকেট বাবু জানালেন, ঢাকা থেকে কয়েকদিনের জন্য বেড়াতে এসেছেন আবদুস সালামের জামাই বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিক-উদ-দৌলা বাবুল। কিছুক্ষণ পর নিচতলায় নেমে এলেন বাবুলও।
মুক্তিযোদ্ধা রফিক-উদ-দৌলা বাবুল বললেন, কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে পড়ার সময় থেকেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হন অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম। বঙ্গবন্ধু অ্যাডভোকেট সালামের চেয়ে বয়সে খানিকটা ছোট ছিলেন। কিন্তু সম্পর্কটা ছিল খুবই ঘনিষ্ঠ। রাজশাহীতে এলে বঙ্গবন্ধু বাড়ির দ্বিতীয়তলায় সিঁড়ির পাশে পশ্চিম দিকে ঘরটাই থাকতেন।
রফিক-উদ-দৌলা বাবুল তখন ওই সময় বৃহত্তর রাজশাহী জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। তিনি আরও বললেন, ‘১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতেই রাজশাহীতে আবদুস সালামের বাড়িতেই প্রথম অপারেশন চালায় পাকহানাদার বাহিনী। অ্যাডভোকেট সালাম তার আগেই সীমান্ত পথে ভারতে চলে যান। তাকে না পেয়ে তার দুই ছেলে কলেজছাত্র ওয়াসিমুজ্জামান ও সেলিমুজ্জামান এবং ভাগ্নিপতি নজমুল হকসহ পরিবারের পাঁচ সদস্যকে হত্যা করা হয়।
রফিক-উদ-দৌলা বাবুল বলেন, অ্যাডভোকেট সালাম মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির অন্যতম প্রাণপুরুষ ছিলেন। সারা জীবন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে ছিলেন। তিনি মারা গেছেন ২০০৬ সালের ২১ ডিসেম্বর। অথচ কারা কীভাবে রাজাকারের তালিকায় তার নাম জুড়ে দিল তদন্ত করা প্রয়োজন।
এদিকে বর্তমানে মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর ও ভাষাসৈনিক অ্যাডভোকেট গোলাম আরিফ টিপুর নামও রয়েছে রাজাকারের তালিকায়। জন্ম চাঁপাইনবাবগঞ্জে।
১৯৫২ সালে রাজশাহী কলেজের ছাত্র থাকাকালে রাজশাহীতে বাংলাভাষা আন্দোলন মূলত তার নেতৃত্বে সংগঠিত হয়। তিনি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের রাজশাহী অঞ্চলের যুগ্ম-আহ্বায়ক ছিলেন।
ভাষাআন্দোলনে বিশেষ অবদানের জন্য সরকার গোলাম আরিফ টিপুকে ২০১৯ সালে একুশে পদক প্রদান করে।
তিনি একাধিকবার রাজশাহী আইনজীবী সমিতির সভাপতি ছিলেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য এবং বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিতও হন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী চাঞ্চল্যকর নীহারবানু হত্যা মামলার আইনজীবী হিসেবে সারাদেশে বিশেষ খ্যাতি লাভ করেন।
একই তালিকায় নাম রয়েছে অ্যাডভোকেট মিয়া মোহাম্মদ মহসিনেরও। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রবাসী সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদের পানিপিয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের ইনচার্জ ছিলেন তিনি। ছিলেন রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও দুইবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য। কিন্তু সরকারি তালিকায় তিনি এখন রাজাকার!
রাজশাহী মহানগর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নান বলেন, যে তালিকায় মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠন, শহীদ পরিবারের নাম এসেছে সেই তালিকা আমরা মানি না। রাজশাহীর এই তিন সংগঠকই মুক্তিযুদ্ধের প্রাণপুরুষ ছিলেন। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেছেন।
বঙ্গবন্ধু পরিষদ রাজশাহী মহানগর শাখার সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক রুহুল আমিন প্রামাণিক বলেন, সরকারের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা স্বাধীনতাবিরোধীরাই উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিতর্কিত এই তালিকা করেছে। সরকারও যেনতেনভাবে তালিকা প্রকাশ করেছে। এটি যাচাই-বাছাই করে প্রকাশ করা উচিত ছিল। তালিকা দ্রুত সংশোধনেরও দাবি জানান তিনি।
এ দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের নাম রাজাকারের তালিকাতে উঠলেও রাজশাহীর কয়েকজন কুখ্যাত রাজাকার, গণহত্যা ও বুদ্ধিজীবী হত্যার সঙ্গে জড়িতদের নাম উঠেনি এই তালিকাতে।
মুসলিম লীগ নেতা আয়েন উদ্দিন ছিলেন রাজশাহীতে বুদ্ধিজীবী হত্যার মূল নায়ক। এই হানাদার দোসরের নামও আসেনি তালিকাতে। যুদ্ধাপরাধ মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত মুসা রাজাকারের নামও নেই। নাম নেই যুদ্ধাপরাধে সদ্য ফাঁসির দণ্ড পাওয়া টিপু রাজাকারের নামও। একাত্তরে রাজশাহীর স্বাধীনতাকামী মানুষের কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক ওয়াহেদ মোল্লার নামও তালিকাতে উঠেনি।
ফলে এই তালিকাকে বিতর্কিত ও মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে আরেকটি গভীর ষড়যন্ত্র বলে মনে করেন রাজশাহীর মুক্তিযোদ্ধারা।