নতুন কৌশলে বিএনপি

দুর্নীতির মামলায় কারান্তরীণ বিএনপিনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন সর্বোচ্চ আদালতের আপিল বিভাগে নাকচ হয়ে গেছে। ফলে তাকে কারাগারেই থাকতে হচ্ছে। দলের প্রধান কারাগারে যাওয়ার পর তার মুক্তিতে ওই অর্থে কোনো জোরালো কর্মসূচিই দিতে পারেনি একযুগেরও বেশি ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি। এতে করে দলটির সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতাকর্মীদের মনোবলে চিড় ধরেছে।
এ ছাড়া জনস্বার্থকেন্দ্রিক বিভিন্ন ইস্যুতেও দলটি সক্রিয় হতে না পারায় শীর্ষ নেতৃত্বকে দুষছেন তারা। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়ার মুক্তি ও জনসম্পৃক্ত বেশকিছু ইস্যুকে সামনে রেখে নতুন কৌশল খুঁজছে দলটি।
সবশেষ বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা তাদের চেয়ারপারসনের মুক্তির জন্য কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারি দেন। তবে তা ঘোষণা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল। এর পক্ষে তাদের যুক্তি, দলের শান্তিপূর্ণ বিভিন্ন কর্মসূচিতেও প্রশাসনের বাধা এবং গ্রেপ্তার-নির্যাতনের ঘটনা বড় কারণ। এরপরও শক্ত কর্মসূচির চাপ আছে তৃণমূল থেকে। তাই নতুন করে কর্মকৌশল ঠিক করার কথা ভাবছেন দলের নীতিনির্ধারকরা। সেক্ষেত্রে শুধু খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয় নয়, জনস্বার্থে দেশের সার্বিক বিষয় নিয়ে মাঠে নামার কথা চিন্তা করছেন তারা।
প্রায় দুই বছর হতে চলল বিএনপিপ্রধান বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে। কারাবন্দি হওয়ার পর থেকে তার মুক্তির প্রহর গুনছেন নেতাকর্মীরা। আইনজীবীদের ভাষ্যও ছিল সহসাই মুক্তি মিলবে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর। কিন্তু তা হয়নি। সবশেষ গতকাল জিয়া চ্যারিটাবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় জামিন পাবেন এমন আশায় বুক বেঁধে ছিলেন নেতাকর্মীরা। কিন্তু জামিন আবেদন খারিজ হওয়ায় সেই আশায় গুড়েবালি।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, শুধু খালেদা জিয়ার মুক্তির ইস্যুই নয় দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে মাঠে নামতে চায় বিএনপি। সেক্ষেত্রে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, পাটকল শ্রমিকদের বকেয়া বেতনের দাবিতে আন্দোলন, সৌদিসহ বিভিন্ন দেশ থেকে নারী শ্রমিকদের ফেরত আসা, বিনা শুল্কে ভারতের ট্রানজিট, এনআরসি ইস্যুকে কেন্দ্র করে কর্মকৌশল ঠিক করতে চান তারা।
গতকাল রাতে বৈঠক করে রবিবার খালেদা জিয়ার মুক্তি চেয়ে বিক্ষোভের ডাক দেয়া হয়েছে। সামনে আরও কর্মসূচি দেয়া হবে জানানো হয়েছে। এ ছাড়া বিএনপির শুভাকাক্সক্ষী হিসেবে পরিচিত সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও দলটির নেতাদের অজুহাত না দিয়ে জনস্বার্থের ইস্যুতে কর্মসূচি প্রণয়ণের পরামর্শ দিয়েছেন।
তবে সরকারের কঠোর অবস্থানের মধ্যে কোন ধরনের কর্মসূচি দেয়া যায় এবং তা পালন করতে নিজেদের কতটা সক্ষমতা আছে তা নিয়েও দুঃশ্চিন্তা রয়েছে বিএনপির ভেতরে। একাধিক কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে আলাপে তেমনটাই বোঝা গেছে।
কেন্দ্রীয় একজন সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘কর্মসূচি নিয়ে নানা মত আছে। কিন্তু সমস্যা হলো কর্মসূচি করে কী হবে? কর্মসূচি শুরু করলে তা কতদিন চালানো যাবে সেটাও চিন্তা করতে হবে। কারণ সরকার তো সব সময় হার্ডলাইনে।’
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে যান খালেদা জিয়া। আর দুই মাস পরই হবে তার জেল জীবনের দুই বছর। তবে এই সময়ে মানববন্ধন, বিক্ষোভ, সমাবেশ, অনশন, গণস্বাক্ষর, কালো পতাকা মিছিল ছাড়া তেমন কোনো কর্মসূচি দেখা যায়নি।
শুরুতে দ্রুত সময়ে আইনি প্রক্রিয়ায় তিনি মুক্তি পাবেন এমন কথা বলতেন আইনজীবীরা। তবে দীর্ঘ চেষ্টায়ও তারা ব্যর্থ হয়ে হাল ছেড়ে দিলেও আইনি চেষ্টার বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই বলে মনে করছেন আইনজীবীরা।
খালেদার জামিন না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘আমরা অপেক্ষা করছি, দেখি দলের হাইকমান্ড কী করেন। কিন্তু আইনজীবী হিসেবে আইনের বাইরে তো কিছু ভাবতে পারছি না। তবে আগের চিন্তা থেকে বের হয়ে নতুন কর্মকৌশল ঠিক করতে হবে। এটাই পরামর্শ।’
সবশেষ গত ৫ ডিসেম্বর আপিল বিভাগে তার জামিন পাওয়াতে বিলম্বিত হওয়ায় ভেঙে পড়েন বিএনপি নেতাকর্মীরাও। হতাশা থেকে আইনজীবীরা বিক্ষোভ দেখিয়েছেন প্রধান বিচারপতির এজলাসে। গতকালও জামিন না মেলায় ঝটিকা বিক্ষোভ হয়েছে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। তবে কোথাও বড় ধরনের কোনো জমায়েত করেনি দলটি।
দলের আরেকজন ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, ‘এতদিন আশায় থাকলেও আপিল বিভাগে জামিন নাকচ হওয়া পুরোপুরি প্রমাণ হয়েছে সরকার না চাইলে খালেদা জিয়ার জামিন হবে না। আর কর্মসূচি দিলেও তা পালন করে সরকারকে বাধ্য করার পরিস্থিতিও নেই। যেভাবেই হোক মাঠে থাকতে হবে, আইনি চেষ্টাও চালাতে হবে। এর বিকল্প নেই।’
দলটির সিনিয়র নেতা খন্দকার মোশাররফ হোসেন গত ৩ ডিসেম্বর প্রেসক্লাবে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ৫ ডিসেম্বর নেত্রীর জামিন না হলে কঠোর কর্মসূচি দেয়া হবে। ওইদিন জামিন হয়নি। কিন্তু মোশাররফের কথা অনুযায়ী কোনো কর্মসূচি দেখা যায়নি। মাঝে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস ও বিজয় দিবস উপলক্ষে কর্মসূচি দেয়া হয়েছে।
এদিকে কর্মসূচি নিয়ে বিএনপির হাইকমান্ডের এমন নরম অবস্থান নিয়ে মাঠ পর্যায়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে নানা কথাবার্তা আছে। কারো অভিযোগ, নিজেদের নিরাপদে রাখতে কঠোর কোনো কর্মসূচির দিকে যাওয়া হচ্ছে না। অন্যদিকে শীর্ষ নেতাদের দাবি, কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামলেই জেল-জুলুমের শিকার হতে হয়।
তবে এমন অজুহাত মানতে রাজি নন বিএনপিপন্থি বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘পুলিশ ধরবে, জেলে যেতে হবে এই অজুহাতের দিন শেষ। মাঠে মানতে হবে। আর এখানে শুধু খালেদা জিয়ার মুক্তি না, আরও যেসব জনস্বার্থের ইস্যু আছে তাও বিবেচনায় নিতে হবে।’
খালেদা জিয়ার জামিন আটকে যাওয়ায় হতাশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘প্রত্যাশা ছিল জামিন পাবেন। সরকার আর একটু চালাকি করলে জামিন দিতে পারত। কারণ জামিন হলেই তো মুক্তি পেতেন না। বিচারকরাও নিজেদের বিবেক দিয়ে পরিচালিত হয়নি।’
গতকাল রাতে স্থায়ী কমিটির বৈঠক শেষে বিক্ষোভের ডাক দেয়া হলেও সামনে কোনো ধরনের কর্মসূচি চূড়ান্ত করা হবে তা নিয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনা করবেন নেতারা। বৈঠক শেষে স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেন, ‘আপাতত কর্মসূচি দেয়া হয়েছে। সামনে কী করা হবে তা নিয়ে আরও আলোচনা হবে। নিশ্চয়ই সবকিছু বিবেচনা করে ঠিক করা হবে।’
সূত্র : ঢাকাটাইমস