চার্লস ১৫টি দেশে আর কত দিন রাজা থাকতে পারবেন?

May 6, 2023 / 04:01pm
চার্লস ১৫টি দেশে আর কত দিন রাজা থাকতে পারবেন?

কমনওয়েলথের ১৫টি দেশে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে চার্লসই রাজা। কিন্তু এই ব্যবস্থা বাতিল করে তারা নিজেদের দেশকে প্রজাতন্ত্রে পরিণত করবে কি না তা নিয়ে এসব দেশে এখন বিতর্ক শুরু হয়েছে। বিভিন্ন দেশে এই বিতর্ক চলছে বিভিন্ন পর্যায়ে। রাজা চার্লসের আনুষ্ঠানিক অভিষেকের প্রাক্কালে বিবিসির সংবাদদাতারা এ রকম কয়েকটি দেশের মানুষদের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করেছেন, আর কত দিন তারা আসলে রাজতন্ত্র চালু রাখবে।

সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিস
খেলার মাঠে দর্শকদের সবার চোখ আটকে আছে ক্রিকেট পিচের দিকে। খেলা হচ্ছে দুটি স্থানীয় প্রতিদ্বন্দ্বী দলের মধ্যে, সেন্ট কিটস এবং নেভিস দ্বীপের দুই নারী ক্রিকেট দল খেলছে একে অপরের বিরুদ্ধে। এখানে যুক্তরাজ্যের প্রভাব এখনো বেশ প্রবল, সেটি জাতীয় খেলা ক্রিকেটে পর্যন্ত।

সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিস দেশটি এই দুই দ্বীপের সমন্বয় গঠিত। আটলান্টিক এবং ক্যারিবিয় সাগরের মাঝখানে দ্বীপ দুটির অবস্থান। ইংরেজ ঔপনিবেশিকরা যখন প্রথম ক্যারিবিয় অঞ্চলে যায়, তখন তারা প্রথম ঘাঁটি গেড়েছিল সেখানেই। কিন্তু স্বাধীনতার ৪০ বছর পরও, এই দেশটির পরিচয় কি হবে, সেটি নিয়ে যেমন বিতর্ক অব্যাহত, তেমনি বিতর্ক চলছে তারা রাজতন্ত্র বাদ দিয়ে প্রজাতন্ত্রের দিকে যাবে কিনা।

দর্শক গ্যালারিতে লোকজনের মৃদু গুঞ্জন মাঝে মাঝে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে উল্লাস-ধ্বনিতে। চিৎকার করে খেলোয়াড়দের দিকে পরামর্শ ছুঁড়ে দিচ্ছেন কেউ কেউ। খেলা যখন একটু ঝিমিয়ে যাচ্ছে, তখন দর্শকদের কাছে তাদের মতামত জানতে গেলে আগ্রহ দেখালেন খুব কম মানুষই। কিন্তু যারা প্রকাশ করলেন, তাদের মধ্যেও পরস্পরবিরোধী মতামত পাওয়া গেল।

শার্লিন মার্টিন বললেন, তিনি আরো বেশি তথ্য চান। রাজা চার্লসকে তাদের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে রেখে লাভটা কী, শেষ প্রশ্ন করলেন তিনি, ‘চীনারা এবং তাইওয়ানিজরা তো আমাদের জন্য ইংল্যান্ডের চেয়ে অনেক বেশি করে, কাজেই আমি জানি না।’

সূর্যাস্তের আগে একটা পানশালায় আরো কিছু স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথাবার্তা হয়। ম্যানেজার জুলিয়ান মোর্টন বললেন, এখানে ব্যাপারটা আসলে জাতির অহমিকার প্রশ্ন : ‘প্রজাতন্ত্রে পরিণত হওয়ার মানে হচ্ছে আমরা আমাদের গন্তব্যে পৌঁছেছি। এর ফলে বাকি বিশ্ব বুঝতে পারবে যে আমরা আমাদের নিজেদের বিষয় নিজেরাই সামাল দিতে পারি।’

জুলিয়ানের বন্ধু ক্রিস্টোফার রবার্টসও এর সঙ্গে একমত হলেন। কিন্তু তিনি বললেন, সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিস এখনো করোনাভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাব কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। কাজেই নিজের দেশকে প্রজাতন্ত্রে পরিণত করাটাকে তিনি জরুরি মনে করছেন না। ‘আমরা এখনো কেবল বিষয়টি নিয়ে আলাপ করছি, রাস্তায় কথাবার্তা বলছি।’

বার্বাডোসের মতো অন্য ক্যারিবিয় দেশের তুলনায় সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিস এখনো নবীন স্বাধীন রাষ্ট্র বলে মনে করেন ক্রিস্টোফার। তিনি মনে করেন, এখানে কোনো পরিবর্তন আনতে সময় লাগবে।

বার্বাডোসকে এক সময় ‘লিটল ইংল্যান্ড’ বলা হতো। ২০২১ সালে তারা রাজতন্ত্র বাতিল করে, এবং এর পথ ধরে অন্যান্য দেশেও একই ধরনের পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা গতি পায়।

কিন্তু সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিসে এরকম পরিবর্তন আনতে হলে গণভোটের মাধ্যমে সংবিধান বদলাতে হবে। সত্যি কথা বলতে কি, ক্যারিবিয় অঞ্চলে যে আটটি দেশ এখনো ব্রিটেনের রাজার রাজ্য হিসেবে পরিগণিত, তার মধ্যে কেবল বেলিজেই এই ব্যবস্থা বিলোপে কোনো গণভোট লাগবে না। সেখানে জাতীয় পরিষদের সিদ্ধান্তেই রাজাকে বাদ দেওয়া যেতে পারে।

তবে এই গণভোটের পথে যেসব বাধা, তা বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকম। যেমন সেন্ট লুসিয়া, বাহামা, জ্যামাইকা এবং সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিসে এ রকম পরিবর্তন আনতে গণভোটে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতাই যথেষ্ট। কিন্তু অ্যান্টিগুয়া অ্যান্ড বারবুডা, গ্রেনাডা এবং সেন্ট ভিনসেন্ট অ্যান্ড গ্রেনাডাইনসে এটি কঠিন হবে। কারণ সেসব দেশের গণভোটে এ রকম পরিবর্তনের জন্য দুই তৃতীয়াংশ ভোটে জিততে হবে।

এ রকম গণভোট করা হয় ২০০৯ সালে সেন্ট ভিনসেন্ট অ্যান্ড দ্য গ্রেনাডাইনসে। তাতে ৪৫ শতাংশ মানুষ রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথকে বাদ দিয়ে তার জায়গায় একজন আলংকারিক প্রেসিডেন্ট বসানোর পক্ষে ভোট দেন। কিন্তু এই সাংবিধানিক পরিবর্তনের জন্য যে দুই তৃতীয়াংশ ভোট দরকার ছিল, তার তুলনায় এটি ছিল অনেক কম।

কাজেই প্রশ্নটা যদিও সহজ, এর প্রক্রিয়াটা তত সহজ নয়। অনেক ক্যারিবিয় রাষ্ট্র তাই এখন যার যার মতো করে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে।

অস্ট্রেলিয়া
আপনি যদি সিডনির কোনো রাস্তা ধরে হেঁটে যান, অস্ট্রেলিয়ায় যে একজন নতুন রাজার অভিষেক হতে যাচ্ছে, তার কোনো কিছু আপনি দেখতে পাবেন না। এক সপ্তাহ ধরে যত লোকের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে, তাদের মধ্যে একজন বাদে সবাই বলেছেন, রাজার রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠান কখন হচ্ছে, তারা জানেন না।

৭৩ বছর বয়স্ক গ্রাহাম বলছিলেন, ‘আমি এটি নিয়ে ভাবি না, আমার এতে কিছু আসে যায় না, এটা অপ্রাসঙ্গিক।’ তার এই মন্তব্য এখানকার মানুষের মনোভাবের সঠিক প্রতিফলন বলে ধরা যেতে পারে।

শনিবার অস্ট্রেলিয়াজুড়ে সব গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা এবং ভবন বেগুনি রঙে আলোকিত করা হবে। কিন্তু অভিষেকের দিনটি উদযাপনের জন্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে খুবই কম, আর সেগুলো নিয়ে তেমন শোরগোলও নেই।

অভিষেক অনুষ্ঠানের বিশেষ টেলিভিশন কভারেজও হবে খুব সীমিত আকারে। সাধারণত রাজকীয় বিয়ে বা রানির শেষকৃত্যানুষ্ঠানও যে রকম ব্যাপক কভারেজ পেয়েছে, তার তুলনায় কিছুই নয়।

রাজা চার্লস রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মতো অত জনপ্রিয় নন। আর রাজা চার্লসের অভিষেক হচ্ছে এমন এক সময়, যখন অস্ট্রেলিয়ায় প্রজাতন্ত্রপন্থীদের আন্দোলন গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থায় আছে।

অস্ট্রেলিয়ায় ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করার জন্য সর্বশেষ গণভোট হয়েছিল ২৫ বছর আগে। তখন গণভোটে এই প্রস্তাব পরাজিত হয়। কিন্তু এ রকম আরেকটি গণভোটের পক্ষে জনমত প্রবল হচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি অ্যালবানিজ এর আগে বলেছিলেন, অস্ট্রেলিয়া একদিন প্রজাতন্ত্র হবেই, এটি অবশ্যম্ভাবী এবং গত বছর তিনি এই প্রজাতন্ত্রের ইস্যুর দায়িত্ব দিয়ে একজন জুনিয়র মন্ত্রী নিয়োগ করেন। অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে এ ধরনের নিয়োগ এটাই প্রথম। কাছাকাছি দেশ নিউজিল্যান্ডেও একই কাহিনী। প্রধানমন্ত্রী ক্রিস হিপকিন্স এ সপ্তাহে বলেছেন, তিনি একজন রিপাবলিকান এবং তিনি বিশ্বাস করেন, একদিন তার দেশ রাজতন্ত্রের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করে বেরিয়ে যাবে।

অস্ট্রেলিয়ায় ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের ভূমিকা একেবারেই আলংকারিক। লোকজন বলছে, যুক্তরাজ্যের ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে অস্ট্রেলিয়া অনেক আগেই নিজেদের স্বতন্ত্র পরিচয় গড়ে নিয়েছে।

অন্যরা রাজতন্ত্রের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করার যুক্তি হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের ওপর উপনিবেশের প্রভাবের কথা উল্লেখ করছে।

১৭ বছর বয়সী এস্টেল প্যাটারসন বলছেন, ‘আমরা সম্ভবত এখন এযাবতকালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উপনিবেশবিরোধী।’ এস্টেলের এক বন্ধু মনিকা জানুলেভিচিউটি বলেন, ‘এখানে একজন ইংরেজ রাজাকে রাজা হিসেবে রাখা খুবই বিদঘুটে মনে হয়।’

কিন্তু অস্ট্রেলিয়াকে প্রজাতন্ত্র ঘোষণার ব্যাপারটি ঘটতে এখনো বেশ কবছর সময় লাগবে বলে মনে হয়। অস্ট্রেলিয়ার সংবিধানে আদিবাসীদের স্বীকৃতির জন্যই গণভোটের আয়োজন করতে হচ্ছে আগে। আর কিভাবে একজন রাষ্ট্রপ্রধান নিয়োগ করা হবে সেই প্রশ্নে অস্ট্রেলিয়ানরা এখনো দ্বিধা-বিভক্ত। রাষ্ট্রপ্রধান কি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হবেন, নাকি পার্লামেন্টের মাধ্যমে নিযুক্ত হবেন?

কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, গণভোটে এরকম একটি ব্যবস্থা পাশ হওয়ার জন্য যে রকম সমর্থন দরকার, সাম্প্রতিক জরিপগুলোতে দেখা যাচ্ছে, সে রকম সমর্থন এখনো নেই। সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারকে গণভোটে এই ব্যবস্থার পক্ষে ভোট দিতে হবে আর অস্ট্রেলিয়ার যে ছয়টি রাজ্য, তার অন্তত চারটিতেও সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন থাকতে হবে।

কানাডা
কানাডায় রাজা চার্লসের ব্যাপারে মানুষের মনোভাবটা কী, তা যদি এক শব্দে প্রকাশ করতে হয়, তাহলে সেটি হবে ‘উদাসীন’। আরেকটু বিশদভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের জন্য কানাডার মানুষের যে ভক্তি ছিল, রাজা চার্লসের জন্য ততটা নেই। জনমত জরিপে দেখা যায়, রাজতন্ত্র থেকে কানাডাকে আলাদা করার পক্ষে সেখানে জনমত ভারী হচ্ছে।

এপ্রিলের শেষে এ রকম সর্বশেষ একটি জরিপের ফল প্রকাশ করে অ্যাঙ্গাস রিড জরিপ সংস্থা। এতে ইঙ্গিত পাওয়া যায়, সংখ্যাগরিষ্ঠ কানাডিয়ান, মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের সামান্য বেশি, তারা চায় না প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তাদের দেশে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র অব্যাহত থাক। আর জরিপের প্রতি পাঁচজন উত্তরদাতার দুজন বলেছে, তারা চার্লসের অভিষেক অনুষ্ঠান নিয়ে মোটেই মাথা ঘামায় না।

কানাডার এই অভিষেক নিয়ে যেরকম দায়সারা গোছের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে, তাতেই তাদের উৎসাহের ঘাটতিটা বোঝা যায়। রাজধানী অটোয়ায় এক ঘণ্টা ধরে একটি অনুষ্ঠান হবে, যেটি টেলিভিশনে দেখানো হবে। আর বিভিন্ন ফেডারেল সরকারি ভবন পান্না সবুজ রঙে আলোকিত করা হবে।

গত বছর চার্লস যখন রাজা হলেন, তখন কানাডায় এই রাজতন্ত্রের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে আবার বিতর্ক শুরু হয়েছিল। বিশেষ করে কুইবেক প্রদেশে, যেখানে রাজতন্ত্রকে অন্য যে কোনো রাজ্যের চেয়ে বেশি নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা হয়। এর কারণ ফরাসী ভাষী এই অঞ্চলটির ইতিহাস।

গত ডিসেম্বরে কুইবেকে একটি নতুন আইন করা হয়, যাতে আইনসভার সদস্যদের রাজার প্রতি আনুগত্যের শপথের বিষয়টি আর বাধ্যতামূলক রাখা হয়নি।

কিন্তু এসবের মানে এই নয় যে, কানাডা বারবাডোস, জ্যামাইকা বা অস্ট্রেলিয়ার মতো একই কাতারে সামিল হয়েছে, যেখানে রাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে আনুষ্ঠানিক বিতর্ক চলছে।

বর্তমান ব্যবস্থা বদলের জন্য হাউজ অব কমন্স এবং সিনেট—পার্লামেন্টের এই উভয় কক্ষের অনুমোদন দরকার হবে, সেই সঙ্গে লাগবে ১০টি প্রদেশের সব কয়টির সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, কানাডায় রাজতন্ত্র বিলোপের পথে এটি বেশ কঠিন এক বাধা।

সূত্র : বিবিসি