গুলিস্তান বিস্ফোরণঃ ইট-সুরকি সরাতেই বেরিয়ে এলো স্বপনের লাশ

সময় তখন বৃহস্পতিবার দুপুর ১২ টা। ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত ভবনের বেজমেন্টে লাশের সন্ধান করতে থাকেন। ইট-সুরকি সরাতে থাকেন ফায়ার সার্ভিসের ৩০-৪০ জন কর্মী। কিছুক্ষনের মধ্যেই সুরকির নিচ থেকে মানুষ পচা গন্ধ বেরুতে থাকে।
দ্রুত হাত চালান তারা। কিছুক্ষনের মধ্যেই একজন মানুষের পা দেখা যায়। আর এ তথ্য পৌছে যায় উপরে থাকা ফায়ার কর্মী, পুলিশ, র্যাবের কাছে। দায়িত্বে থাকা প্রতিটি সংস্থার কর্মীরা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন।
দু’জন ভবন থেকে কিছুটা দূরে রাখা অ্যাম্বুলেন্স থেকে স্ট্রেচার নিয়ে দৌড়ান বেজমেন্টের দিকে। একজন ফায়ার কর্মী সাদা রঙের বডি ব্যাগ নিয়ে দৌড়ান সেখানে। মিডিয়া কর্মীদের ক্যামেরার চোখও তখন সেই স্থানটির দিকে। আর পাশে ঢুকরে কান্না করছিলেন এক বৃদ্ধ।
বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্থ রাজধানীর গুলিস্তানের সিদ্দিকবাজারের ক্যাফে কুইন ভবনের সামনে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরের দৃশ্য এটি। ১২ টা ২১ মিনিটে লাশটি উদ্ধার করার পর ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের চোখে মুখে স্বস্থির ঝিলিক দেখা যায়।
কারন সব শেষ একজন আটকে থাকা বা তার মরদেহ ভবনের বেজমেন্টে থাকার তথ্য ছিল। শেষ পর্যন্ত নিখোজ থাকা মেহেদী হাসান স্বপনের লাশ উদ্ধার করার সঙ্গে সঙ্গে উদ্ধার তৎপরতাও শেষ হয়।
ভয়াবহ বিস্ফোরণের উদ্ধার তৎপরতা নিয়ে কথা হয় কয়েকজন ফায়ার কর্মীর সঙ্গে। তারা গতকাল কালের কণ্ঠকে জানান তাদের অভিজ্ঞতার কথা। তাদেরই একজন ফয়ার সার্ভিসের ঢাকা বিভাগের সহকারী পরিচালক আক্তারুজ্জামান। তিনি বলেন, মঙ্গলবার বিকালে আমরা ফায়ার সার্ভিস হেডকোয়ার্টার্সে ছিলাম। হঠাৎই বিকালে খবর পাই গুলিস্তানের একটি ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে।
সঙ্গে সঙ্গে ফায়ার সার্ভিসের তিনটি অ্যাম্বুলেন্সসহ ফায়ার ইউনিট পঠানো হয় ঘটনাস্থলে। আমরাও আমাদের ব্যবহৃত ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে রওনা দেই ঘটনাস্থলে। গিয়ে যানজটে পড়তে হয়। কিছুদূর থেকেই দেখি আহত রক্তাক্ত লোকজনকে।
আমরা গাড়ি ছেড়ে দেই আহতদের হাসপাতালে পাঠানোর জন্য। দৌড়ে ঘটনাস্থলে যাই। ততক্ষনে ফায়ারের গাড়ি ও অ্যাম্বুলেন্সও পৌছে যায় সেখানে। সেখানে তখন ভয়ঙ্কর এক অবস্থা। সেখান থেকে আমরা কয়েকটি ইউনিট চেষ্টা চালাই পুরো উদ্ধার তৎপরতা চালানোর জন্য।
ফায়ার কর্মী দোলন কালের কণ্ঠকে জানান, প্রথম দিন বিকালে ঘটনাস্থলে পৌছে আমরা উদ্ধার তৎপরতার দিকেই বেশি নজর দেই। তখন মানুষের চিৎকার, রক্তাক্ত মানুষের চেহারা চোখের সামনে। আমরা কোন সময় যে বেজমেন্টের ভেতরে ঢুকে যাই খেয়ালই করিনি।
তখন বিধ্বস্ত ভবন থেকে ধুলো বালি উড়ছিল। আহত মানুষগুলোরও চেহারাও বদলে গিয়েছিল। আহত ও নিহতদের লাশ উদ্ধার করে একের পর এক অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দেই।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা তখন ভবনটি ভেঙ্গে যেতে পারে, বেজমেন্টে গেলে নিজেদের ক্ষতি হতে পারে এসব বিষয় মাথায়ই আনিনি। আমরা তখন মানুষকে কিভাবে বাঁচানো যাবে সে চেষ্টা করে গেছি। বিকাল পেরিয়ে রাত হয়ে গেলেও আমরা আমাদের কাজ থামাইনি।
তবে কাজ করতে গিয়ে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল। ভবনটির নিচ তলা ও দোতলার ভাঙ্গা অংশও গিয়ে বেজমেন্টে পড়ে বিশাল স্তুপে পরিণত হয়। ফলে ওই স্তুপের নিচে তাৎক্ষনিকভাবে উদ্ধার অভিযান চালানো সম্ভব হয়নি।
মঙ্গলবার রাতে ফায়ার সার্ভিস উদ্ধার তৎপরতা বন্ধ করার পর পরদিন বুধবার সকালে আবারো উদ্ধার অভিযানে যায়। তখন সংবাদ পাওয়া যায় তিনজনকে খুজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাদের মধ্যে বাংলাদেশ স্যানিটারির ম্যানেজার মেহেদী হাসান স্বপন, আনিকা স্যানিটারির মালিক মমিন উদ্দিন সুমন, কর্মচারী রবিন হোসেন শান্তর স্বজনরা খুঁজতে আসেন।
বুধবার বিকালে মমিন উদ্দিন সুমন ও রবিন হোসেনের লাশ উদ্ধার করতে সমর্থ হয় ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা। কিন্তু সেদিন মেহেদী হাসান স্বপনকে উদ্ধার করা যায়নি। স্বপনের শ্বশুর আব্দুল মান্নান লাশ উদ্ধারের পর ছুটে যান লাশ দেখতে।
সেখানে স্বপনের লাশ না পেয়ে ফিরে গিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে থাকেন। আবদুল মান্নান গতকাল বৃহস্পতিবারও সকাল থেকে উপস্থিত ছিলেন ক্ষতিগ্রস্থ ভবনের সামনে। শেষ পর্যন্ত স্বপনের লাশটি উদ্ধারের পর তিনি চিৎকার করে কান্না করতে থাকেন এবং ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের জন্য হাত তোলে দোয়াও করেন।
ভিডিওটি দেখতে এখানে ক্লিক করুন