আনন্দে মুখর ভিকারুননিসার শিক্ষার্থীরা

স্কুল খোলায় খুশি শিক্ষার্থী সামিয়া সুলতানা। মা শামীমা সুলতানা যেন আরও খুশি। রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী সামিয়া রোববার সকাল ৮টায় স্কুলে আসেন। স্কুলের বাইরে ফুটপাতে বসে অপেক্ষা করছিলেন মা। রোদে পুড়ছে চেহারা।
তবে যা বলার বলে দিচ্ছিল তার (মায়ের) চোখ-মুখ। জানালেন, তার পরিবারে আজ যেন ঈদের দিন। ৫৪৪ দিন পর মেয়ের সঙ্গে স্কুলে আসলেন। আনন্দে চোখে জল আসে মায়ের। কথা হয় সামিয়ার সঙ্গেও। জানাল, যে স্বপ্ন দেখেছিল সে- তা পূরণ হবে। এখন পুরোদমে পড়াশোনা হবে। আসলে স্কুলশিক্ষক ছাড়া কি কখনো পড়াশোনা হয়?
সকাল ৯টায় স্কুলে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে নানান রঙের বেলুন, গাছ-দেয়াল আর ক্লাস রুমে টাঙানো ‘সু-স্বাগতম প্রিয় শিক্ষার্থী-অভিনন্দন প্রিয় শিক্ষার্থী’ ফেস্টুন। অধিকাংশ শিক্ষকই একই রঙের পোশাক পড়েছেন।
প্রবেশ পথে সারি সারি দাঁড়িয়ে শিক্ষার্থীদের অভিবাদন জানাচ্ছেন করতালির মধ্য দিয়ে। আর বাইরে অপেক্ষারত শত শত অভিভাবক আনন্দে মেতে উঠেছেন। কেউ আবার হাতে খাবার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
স্কুলের ক্যান্টিন সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে। শিক্ষার্থী-শিক্ষক, পরিচ্ছন্নকর্মী থেকে দারোয়ান সবার মুখে মাস্ক। কিন্তু একে অপরকে চিনতে ভুল হচ্ছে না। স্কুল খোলার প্রথম দিন শিক্ষকরাও সহকর্মীদের সঙ্গে হাসিখুশিভাবে কুশলবিনিময় করেছেন।
করোনা সংক্রমণ রোধে এবং স্কুলের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সুরক্ষিত রাখতে গত বছরের ১৭ মার্চ দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। সম্প্রতি ১২ সেপ্টেম্বর থেকে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার ঘোষণা দেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। আগামী অক্টোবরের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও খুলে দেওয়া হতে পারে। অর্থাৎ ৫৪৪ দিন পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হলো।
স্কুলশিক্ষক থেকে শিক্ষাবিদ প্রত্যেকেই মনে করছেন করোনা মোকাবিলা করতে গিয়ে সব থেকে বেশি ক্ষতি হয়েছে শিক্ষার্থীদের। গত দেড় বছর ধরে স্কুল বন্ধ। মুছে যাচ্ছে স্কুল জীবনের এক-একটা দিন। চার দেয়ালে বন্দি থেকে ছোট-ছোট ছেলেমেয়েগুলোর মন খারাপ ছিল বেশিরভাগ সময়ই।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, স্কুলের আঙ্গিনা থেকে শুরু করে ক্লাসরুম-টয়লেট, ওয়াশরুম সবই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে। প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে হ্যান্ড স্যানিটাইজার দেওয়াসহ তাপমাত্রা মাপা হচ্ছে। শিক্ষার্থী থেকে শিক্ষক-সহকর্মীরা সবাই মাস্ক পরে আছেন।
তিনটি বড় মাঠ, প্লে কর্নারে খেলতে দেখা গেছে শিক্ষার্থীদের। কেউ আবার মাঠে দৌড়াচ্ছে। রয়েছে মেডিকেল কর্নারও। দুইজন চিকিৎসকসহ ৪টি বেড এবং আইসোলেশনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
দুপুরের দিকে এক শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পরলে দ্রুত মেডিকেল কর্নারে তার চিকিৎসা হয়। অল্প সময়ের মধ্যেই সুস্থ হয়ে উঠে শিক্ষার্থী। এ ছাড়া মালি, দারোয়ান আর পরিচ্ছন্ন কর্মীদের ব্যস্ত থাকতে দেখা গেছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির সিনিয়র শিক্ষক সঙ্গীতা ইমাম জানান, প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে সারিবদ্ধভাবে স্কুলে প্রবেশ ও বাহির করা হচ্ছে। শিক্ষকরা প্রবেশ পথে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে শিক্ষার্থীদের অভিনন্দন জানাচ্ছেন।
পর্যাপ্ত মাস্কসহ করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে সুরক্ষাসামগ্রী প্রতিষ্ঠানটিতে রয়েছে। আমরা দুটি শিফটে ক্লাস নিচ্ছি। শিক্ষার্থীদের জেট পদ্ধতিতে একটি টেবিলে ২ জন করে বসানো হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা বাসা থেকেও হ্যান্ড স্যানিটাইজার নিয়ে আসছে।
তিনি বলেন, ক্লাসে পড়াশোনার সঙ্গে স্বাস্থ্যবিধি মানা ও পরিবারের সবাইকে নিয়ে করোনামুক্ত থাকার বিষয়েও শিক্ষার্থীদের সচেতন করছেন শিক্ষকরা।
এদিকে স্কুল বন্ধ থাকার জন্য যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেছে বলে মনে করছেন অভিভাবক রাজিয়া বিনতে রহমান। বললেন, পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়ে অনেক কিছুই ভুলে গেছে। তবে আশা করছি, সব পুষিয়ে নেবে সে।
নিশ্চিত করে বলতে পারি, স্কুলশিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পুঁথিগত শিক্ষার বাইরেও সামাজিকতা, মানসিকতা গড়ার ক্লাস হয়। অনলাইন শিক্ষা কখনই স্কুলের বিকল্প হতে পারে না।
প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী উম্মে হুমায়রা বলছিল, ‘প্রথম ক্লাস খুব ভালো লাগছে। আম্মু সঙ্গে এসেছে, বাইরে বসে আছে। আমি মাস্ক পরে থাকব। বাসায় গিয়ে খুলব। খাবার নিয়ে আসিনি, আম্মুর কাছে খাবার আছে। তবে আমার ক্ষুধাও লাগেনি’।
প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থীদেরও সারিবদ্ধভাবে হ্যান্ড স্যানিটাইজার দেওয়া হয়। প্রত্যেককে মাস্ক পরা অবস্থায় স্কুলে প্রবেশ করানো হয়েছে। অন্যদিকে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনের রাস্তাগুলোয় অস্থায়ী বিভিন্ন খাবার সামগ্রী ও পণ্য বিক্রেতাদের ভিড় জমেছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ কামরুন নাহার যুগান্তরকে বলেন, স্কুল খোলার ভাবনাকে ইতিবাচক পদক্ষেপ বলে মনে করছি আমরা। প্রথম দিন গড়ে প্রায় ৯৮ শতাংশ শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিল। আমরা অনেক খুশি।
গত প্রায় এক সপ্তাহ ধরে স্কুল ও স্কুলের আশপাশ পরিচ্ছন্ন করাসহ ভেতরে বেলুন, ক্লাসরুমে বেলুন-ফেস্টুন লাগিয়েছি। আমরা শিক্ষকরা একই রঙের পোশাক পরেছি। প্রবেশ পথে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে শিক্ষার্থীদের অভিনন্দন জানিয়েছি। হ্যান্ড স্যানিটাইজারসহ করোনা সুরক্ষায় যা যা প্রয়োজন- সবই আমাদের প্রতিষ্ঠানে রয়েছে।
ভিডিওটি দেখতে এখানে ক্লিক করুন