বিএনপি ভারতের সঙ্গে ‘কান্ট্রি টু কান্ট্রি’ সম্পর্ক চায়

প্রকাশিত: সেপ্টে ৯, ২০২১ / ১১:১৬অপরাহ্ণ
বিএনপি ভারতের সঙ্গে ‘কান্ট্রি টু কান্ট্রি’ সম্পর্ক চায়

দেশের অন্যতম প্রাচীন ও বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি। চলতি মাসের ১ সেপ্টেম্বর ৪৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করে ৪৪ বছরে পা দিয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠার পর থেকে বর্তমানে সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছে দলটি। দীর্ঘ ১৪ বছর ক্ষমতার বাইরে আছে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া দলটি।

বিশেষ করে ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জনের পর থেকে বিএনপির রাজনীতি অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। এরপর ২০১৫ সালের তিন মাসের টানা অবরোধ কর্মসূচির কারণে বিএনপিকে দেশে-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়তে হয়।

তবে বিএনপি বরাবর অভিযোগ করে আসছে, ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিবেশী দেশ ভারতের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে একদলীয় শাসন কায়েম করেছে। ফলে বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা অনেকটা প্রকাশ্যে ভারতের বিরোধিতা করেই বক্তব্য দিতেন।

২০১৮ সালের ডিসেম্বরে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে অঘোষিতভাবে বিএনপি প্রকাশ্যে ভারত বিরোধিতার পথ থেকে সরে এসেছে। মূলত বিএনপির বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দলের দায়িত্বভার গ্রহণের পর থেকেই ভারতবিরোধী মনোভাব অনেকটা কমেছে দলটির নেতাকর্মীদের ভেতর।

৪৩ বছরের বিএনপির চ্যালেঞ্জ এবং ভারতসহ প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে বিএনপির অবস্থান কী হবে এসব বিষয়ে কথা হয় দলটির দুজন সংসদ সদস্য ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে কাজ করা দলের সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদের। প্রতিবেশীদের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক ও কূটনৈতিক নীতি কী হবে তা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করেছেন দলটির নেতারা।

বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও দলীয় সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল করি, আমরা নির্ভর করি আমাদের দেশের জনগণের ওপর। জনগণের শক্তিটাই আমাদের কাছে বড় শক্তি। ‘

এর বাইরে বড় কোনো শক্তি নেই। তবে আন্তর্জাতিকভাবে ভারত, চীনসহ অন্য প্রতিবেশীরা বাংলাদেশের ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করুক বা ভূমিকা রাখুক এটা আমরা প্রত্যাশা করি না।’

হারুনুর রশীদ বলেন, ‘তবে ভারত এখানে যেভাবে আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিচ্ছে বা ক্ষমতায় বসিয়ে রাখছে—এটা একান্তই তাদের স্বার্থগত কারণে। একমাত্র স্বার্থের কারণে এখানে তারা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসিয়ে রেখেছে। এটা বিএনপিসহ অন্য কোনো জনগণের রাজনৈতিক দলের পক্ষে নিঃস্বার্থভাবে ভারতের সমস্ত আবদার বা দাবি-দাওয়া অনুমোদন দেওয়া সম্ভব না।

এমনকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, ভারতকে তিনি যা দিয়েছেন তা ভারতকে সারা জীবন মনে রাখতে হবে। এটা তিনি সত্য কথাই বলেছেন।’

বিএনপির এই যুগ্ম মহাসচিব বলেন, ‘আওয়ামী লীগ যেভাবে ভারতকে উজাড় করে দিয়েছে, সেটা বিএনপি ক্ষমতায় থেকে জীবনেও পারবে না। আর বাংলাদেশের জনগণ এটা বিএনপিকে সমর্থনও দিবে না। আমরা প্রত্যাশা করি, একটা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। এ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ যাকে ক্ষমতায় বসাবে, তাদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিবে।’

ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে হারুনুর রশীদ বলেন, ‘ভারত আমাদের প্রতিবেশী বৃহৎ রাষ্ট্র, আমরা আশা করি ভারতের সঙ্গে আমাদের যেসব অমীমাংসিত বিষয় রয়েছে সেগুলো বন্ধুত্বপূর্ণ উপায়ে সমাধান করা জরুরি।

আমরা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে সমাধানের প্রত্যাশা করি। ভারত কোনো একটি দলকে নয়, বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গেই ভারতের সম্পর্ক। সরকার টু সরকার নয়, কান্ট্রি টু কান্ট্রি সম্পর্ক চায় বিএনপি।’

বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও দলের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে কাজ করা শামা ওবায়েদ এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘বিএনপির পররাষ্ট্রনীতি হচ্ছে আমাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের তৈরি করা ফরেইন পলিসি। প্রতিবেশী দেশসহ সবার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা।

দেশনেত্রী খালেদা জিয়া এবং বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বেও দলের একই ফরেইন পলিসি বজায় আছে। সেটি হলো সবার সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গেই বৈরিতা নয়। এবং সেটি হতে হবে নিজের দেশের এবং দেশের মানুষের স্বার্থ সংরক্ষণ করে। সেটাই আমাদের ফরেইন পলিসি, সেটাই ফলো করি।’

এক প্রশ্নের জবাবে শামা ওবায়েদ বলেন, ’৯০-এর দশকের সঙ্গে ২০২১-এর তুলনা করলে ভুল হবে। ২০২১ এসে ভৌগোলিক রাজনীতি, দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি বা বিশ্ব রাজনীতি সব পরিবর্তন হয়ে গেছে। করোনার পরে ভ্যাকসিন রাজনীতি শুরু হয়ে গেছে।

এগুলো সব কিছু আমলে নিয়ে বিএনপি কাজ করছে। চীনের সঙ্গেও বিএনপির সব সময় ভালো সম্পর্ক ছিল। ভারতের সঙ্গে বিএনপির খারাপ সম্পর্ক—এটা মোটেই ঠিক নয়। পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, ভারতের সঙ্গেও বিএনপির একটি সম্পর্ক আছে।

কূটনৈতিক সম্পর্ক আছে, তাদের সঙ্গে কোনো সমস্যা নেই। তবে একটা পারসেপশন আছে হয়তো, সেটি হলো ২০১৪ সালের আগে পরে ভারত একটি বিশেষ দলকে প্রেফার করেছিল। সেটি অস্বীকার করা যাবে না।

শামা ওবায়েদ বলেন, ‘আমি মনে করে এদেশের নাগরিক হিসেবে, ভারতেরও রিয়েলাইজেশন হয়েছে, একটি নির্দিষ্ট দলের সঙ্গে নয়, পিপল টু পিপল এবং কান্ট্রি টু কান্ট্রি রিলেশনশিপ ডেভেলপ করতে হবে।

তাহলেই আমাদের পারস্পরিক যে সমস্যাগুলো আছে, সেগুলোর একটা সমাধানে সুবিধা হবে। যদি একটি দল নয়, সব দলের সঙ্গে, দেশের জনগণের সঙ্গে, পিপল টু পিপল কানেকটিভিটি করে। আমি আশা করি, ভারত এতদিনে নিশ্চয়ই সেটা অনুধাবন করেছে।’

বিএনপির নেতাদের ভারতবিরোধী বক্তব্যের বিষয়ে শামা ওবায়েদ বলেন, ‘আমাদের সিনিয়র নেতৃবৃন্দ যখন বক্তব্য রাখেন তখন তারা কোনো না কোনো ইস্যুতে কথা বলেন। যখন কোনো কিছু ঘটে তখন তার প্রতিক্রিয়াতে বক্তব্য দেন।

সেটা ভারতবিরোধী নয়, জাতীয়তাবাদী আদর্শ থেকে রাখেন। যখন বর্ডার কিলিং হয়, তখন সেগুলোর বিরুদ্ধে কথা বলতেই হবে জাতীয়তাবাদী দল হিসেবে। সেটা জনগণও আশা করে।

আমরা জনগণের হয়ে কথা বলি। এমনকি যখন ভারতের সঙ্গে কথা হয়, তখন তাদের বলি সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসো। ভারতের সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক আছে, সেটা বজায় থাকবে। এ ছাড়া প্রতিবেশী সব দেশের সঙ্গেই আমাদের সুসম্পর্ক আছে।’

সংসদে বিএনপি দলীয় হুইপ ও দলের আন্তর্জাতিক কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘বিএনপি সব সময় বিশ্বাস করে, সব দেশের সঙ্গে সমমর্যাদার ভিত্তিতে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক।

ভারতও তার ব্যতিক্রম নয়। বিএনপি সব সময় ভারত বলেন বা যে দেশই বলেন, সবার সঙ্গে সমমর্যাদার একটি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক করতে চেয়েছে। সেটার ধারাবাহিকতা এখনও অব্যাহত আছে।’

রুমিন ফারহানা বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি না দেশের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে কোনো একটি দেশকে সর্বক্ষেত্রে লাভবান করা যাবে, শুধু যাতে আমরা ক্ষমতায় যেতে পারি বা ক্ষমতায় থাকতে পারি।

আমরা বিশ্বাস করি আমার দেশের স্বার্থ রক্ষা করে, দেশের মানুষের স্বার্থ রক্ষা করে একটি সমমর্যাদার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। এবং সেটি হতে হবে দেশের সঙ্গে দেশের, জনগণের সঙ্গে জনগণের। এবং সেটি আমরা যে কোনো দেশের সঙ্গে করতে আগ্রহী।’

ভিডিওটি দেখতে এখানে ক্লিক করুন