আরব যুবরাজদের দ্বন্ধে বাজিমাত করল এরদোগান

ঘনিষ্ঠ মিত্র থেকে এখন প্রায় শত্রুর পর্যায়ে পৌঁছে গেছেন সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ও আরব আমিরাতের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান। ইনসেটে তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান
২০২১ সালটি যেন মধ্য প্রাচ্যকে নতুন করে সাজাচ্ছে। ওখানকার ভূ-রাজনৈতিক অবস্থার অভূতপূর্ব পরিবর্তন শুরু হয়েছে এ বছরের শুরু থেকেই। সে পরিবর্তনগুলো আস্তে আস্তে আরও দৃশ্যমান হচ্ছে।
বিশেষ করে উপসাগরীয় অঞ্চলে দ্বিপাক্ষিক এবং আঞ্চলিক সম্পর্ক নতুন করে সাজানো হচ্ছে। গত দশ বছরের মেরুকরণ ভেঙে এখন আবার নতুন নতুন সম্পর্ক গড়ছে পুরোপুরি বিপরীত মেরুর দেশগুলো।
ওই অঞ্চলের দেশগুলোর আগামী কয়েক দশকের গতিপথ নির্ধারণ হচ্ছে এবং এ গতিপত পুরপুরি স্পষ্ট হবে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে। এ নিয়ে কয়েকটি ভিডিওতে বিস্তারিত আলোচনা করবো। তবে আমাদের আজকের বিষয় তুরস্ক এবং আরব আমিরাতের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে।
প্রায় দশ বছরের বৈরী সম্পর্কের পরে তুরস্ক ও আরব আমিরাত আবারও নতুন করে ঘনিষ্ঠ হচ্ছে। উচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগ করছেন দু দেশের নেতৃবৃন্দ। সম্পর্ক বৃদ্ধির কথা বলছেন তারা। অনেকেই এটাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন, আবার কেউ কেউ দেখছেন সন্দেহের চোখে ।
অনেকে বলছেন আরব আমিরাত হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সব সমস্যার মূল। তাই এই দেশটিকে বিশ্বাস করা ঠিক হবে না। তাদের মতে আরব আমিরাত যদি তুরস্কের খুব কাছে আসতে চায় তাহলে এর পিছনে নিশ্চয়ই অন্য কোন ফন্দি থাকতে পারে।
তবে আমরা যদি সাম্প্রতিক মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থার দিকে লক্ষ্য করি এবং পরিবর্তনগুলোকে মূল্যায়ন করি তাহলে দেখতে পাব যে গত এক বছর আগেও ওখানকার এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের সম্পর্ক যা ছিল সাম্প্রতিক সময়ে তার প্রায় পুরোটাই ইউটার্ন করেছে।
যেমন এক সময়ে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মাদ বিন সালমান এবং আবুধাবির যুবরাজ মোহাম্মদ বিন জায়েদের মধ্যকার ব্যক্তিগত সম্পর্ক অনেক মধুর ছিল। যদিও তাদের বয়সের পার্থক্য প্রায় ২৫ বছর, কিন্তু এ পার্থক্য তখন তাদের বন্ধুত্বে কোন বাধা হতে পারেনি।
এই দুই যুবরাজই কার্যত তাদের দেশ শাসন করেন এবং তাদের লক্ষ্যও উচ্চাকাঙ্ক্ষী। অনেক বছর ধরে দুই দেশের মধ্যে কৌশলগত বিষয়ে গভীর সহযোগিতা ছিল।
এমনও মনে করা হয়েছিল যে, তারা মধ্যপ্রাচ্যকে নতুন করে জাগিয়ে তুলবেন। কিন্তু আস্তে আস্তে সে সম্পর্কে ঘুণ ধরতে শুরু করে। ঘনিষ্ঠ মিত্র থেকে এখন প্রায় শত্রুর পর্যায়ে পৌঁছে গেছেন তারা। তাদের বর্তমানের এই বৈরী সম্পর্ক আবারো প্রমাণ করলো যে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বন্ধুত্ব স্বার্থে আঘাত লাগা পর্যন্ত স্থায়ী হয়।
মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমেরিকার হাত গুটিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্তে ওই অঞ্চলের সব দেশ নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে তাদের দ্বিপাক্ষিক এবং বহুপাক্ষিক সম্পর্ক নিয়ে। নতুন করে সংজ্ঞায়িত করছে তাদের শত্রু এবং মিত্রদের। সবাই এখন নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত।
সৌদি আরব, কাতার, আরব আমিরাত, মিশর, জর্ডান, ইরাক, ইরান, সিরিয়াসহ প্রায় সবাই এখন নতুন করে ভাবছে নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে। এতদিন আমেরিকার কোলে বসে যারা নাচত আর অন্যের নাচন দেখতো তাদেরও সে তাসের ঘর ভেঙে গেছে।
সুতরাং এখানে তুরস্ক এবং আরব আমিরাতের সম্পর্ককে যদি শুধুমাত্র এই দুটি দেশকে নিয়ে মূল্যায়ন করি তাহলে হয়তো অনেক কিছুই বোঝা সম্ভব হবে না। এই সম্পর্ককে মূল্যায়ন করতে হবে পুরো অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং সবগুলো দেশের সম্পর্ককে সামনে রেখে।
২০১১ সালের সেই তথাকথিত আরব বসন্তের ছোঁয়ায় যখন মধ্যপ্রাচ্যে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা হচ্ছিল, তখন তুরস্ক এবং কাতার ওইসব দেশে মুসলিম ব্রাদারহুডকে সাপোর্ট দেয়। গণতন্ত্রের বাণী শোনায়।
কিন্তু এগুলো অনেক দেশের শাসকদের মসনদ ধরে টান দেয়। শেষপর্যন্ত দুটো বলয় তৈরি হয়। তুরস্ক-কাতার-মুসলিম ব্রাদারহুড বলয়। আর আরব আমিরাত-সৌদি আরব-মুসলিম ব্রাদারহুড বিরোধী বলয়।
আস্তে আস্তে এই মেরুকরণ আরও স্পস্ট ও প্রশস্ত হয়। একদিকে থাকে আমিরাত-সৌদি-মিসর-বাহরাইন এবং ইসরাইল। অন্যদিকে থাকে তুরস্ক-কাতার এবং ইরান।
সৌদি-আমিরাত বলয় আরও বৃদ্ধি পেতে থাকে। তাতে যোগ দেয়, ভারত, গ্রীস, সাইপ্রাস, ফ্রান্স, ইরাক, সিরিয়া। আর তুর্কি কাতার বলয়ে যোগ দেয় আজারবাইজান এবং পাকিস্তান।
উভয় মেরুই একে অপরের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়। তবে তুরস্ক-কাতার বলয়কে সরাসরি আক্রমণের মুখে পড়তে হয়। যেমন- কাতারের বিরুদ্ধে বয়কট, তুরস্কে সামরিক অভ্যুত্থান ইত্যাদি। এই দেশগুলোকে পড়তে হয় চতুর্মুখি আক্রমণের মুখে।
তাদেরকে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে ধ্বংসের প্রচেষ্টা চলতে থাকে। অন্যদিকে সৌদি-আমিরাত বলয় মুসলিম ব্রাদারহুডের কারণে অস্বস্তিতে থাকে। সঙ্গে যোগ হয় খাসোগজির হত্যা এবং ইয়েমেন যুদ্ধ আর আমেরিকার অবহেলা।
উভয় মেরুই মূলত অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হতে থাকে। আন্তর্জাতিকভাবে হয়ে পরে কোনঠাসা ।
তুরস্ককে বাঁচাতে ছুটে আসে কাতারের অর্থ, আর সৌদি-জোটের অবরোধ থেকে কাতারকে বাঁচাতে যায় তুরস্ক এবং ইরানের পণ্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তুরস্ক-কাতার-ইরান বলয় শত ঝড়ঝাপটা সত্ত্বেও টিকে থাকতে সক্ষম হয়।
যদিও অর্থনীতি একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকে।তবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আস্তে আস্তে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। পশ্চিমারা কিছুটা কাতারের দিকে ঝুঁকতে থাকে।
বিশেষ করে আফগানিস্তান বিষয়ে আমেরিকা এবং তালেবানের মধ্যস্থতায় কাতার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চলে যায় এক নতুন উচ্চতায়। এই বলয়ের বন্ধন আরও শক্তিশালী হয়। অর্থনীতির চেয়ে সামরিক এবং আন্তর্জাতিক ফোরামে একে অপরকে আরও বেশি সাপোর্ট দেয়।
অন্যদিকে সৌদি আরব-আমিরাত জোটও অর্থনৈতিক দিক থেকে দুর্বল হয়ে পরে। তেলের মূল্যহ্রাস, করোনার আক্রমণ এবং ইয়েমেনের যুদ্ধের কারণে নিজেদের মধ্যে ঝামেলা শুরু হয়। আস্তে আস্তে ওই বলয়ে ভাঙন ধরে। সৌদির সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক খারাপ হয়। আমিরাত-সৌদি সম্পর্কেও শুরু হয় টানাপড়েন। মিশর বেঁছে নেয় নিজের পথ।
ওই জোটের সবাই আবার নতুন করে সম্পর্ক গড়া শুরু করে এই তুরস্ক-কাতার-ইরান জোটের সঙ্গে। কাতারের ওপর থেকে অবরোধ উঠিয়ে নেয় সৌদি জোট। ইরানের সঙ্গে সৌদি আরব সম্পর্ক গড়তে শুরু করেছে। মিসরের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে আলোচনা চলছে। কাতারের সঙ্গে সৌদির সম্পর্ক প্রায় আগের জায়গায় চলে গেছে। তুরস্কের সঙ্গেও সৌদি সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে ইচ্ছুক।
অন্যদিকে তুরস্ক এবং কাতারও মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতি তাদের সমর্থন কমিয়ে আনছে। এই দুই দেশের সমর্থিত মুসলিম ব্রাদারহুড পরিচালিত গণমাধ্যমগুলোকে মিশর, আমিরাত এবং সৌদি আরবের বিরুদ্ধে নেতিবাচক খবর প্রচার থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছে।
সব কিছু মিলিয়ে মধ্য প্রাচ্যে নতুন এক দিগন্তের সূচনা হচ্ছে। মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্ক আবার সেই ২০১১ সালের আগে ফিরে যাওয়ার অনেক ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে তুরস্কের সঙ্গে মিশর এবং সৌদি আরবের সম্পর্ক গড়ার কাজ ধীর গতিতে আগাচ্ছে। কিন্তু আরব আমিরাতের সঙ্গে সম্পর্ক অনেক দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। এর অবশ্য কয়েকটি কারণও আছে।
সৌদি আরব এবং মিশরের সঙ্গে তুরস্কের বড় দুটো সমস্যা আছে যেগুলো আরব আমিরাতের সঙ্গে নেই। যেমন- সৌদি আরবের সাংবাদিক জামাল খাসগজির মৃত্যুর সব দলিল দস্তাবেজ তুরস্কের হাতে আছে যা ভবিষ্যতে সৌদি প্রিন্সের মাথাব্যাথার কারণ।
এ কারণে যুবরাজ মোহাম্মাদ বিন সালমানের ভবিষ্যৎ খুব একটা মসৃণ হবে না। তার বাদশা হওয়ার স্বপ্নে সব সময়ই পথের কাঁটা হয়ে থাকবে এই খাসগজি হত্যা ঘটনা।
আর মিশরের শাসক আব্দুল ফেত্তাহ আল সিসি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা। তার গদি অতোটা শক্তিশালী না। পশ্চিমারা নাড়াচাড়া দিলে যেকোনো সময় পরে যেতে পারে। আর তুরস্কও তাকে সরাসরি আক্রমণ করেছে।
তুরস্কের এই সামরিক জান্তা বিরোধী অবস্থান সহজে পরিবর্তন হওয়ার নয়। উপরে উপরে পরিবর্তন হলেও তুরস্ক সবসময় সামরিক জান্তা বিরোধী অবস্থানে থাকবে। তাই সৌদি আরব এবং মিশর এই দুই বিষয় নিয়ে তুরস্ককে বিশ্বাস করতে পারছে না। এবং তুরস্ক এখানে শক্তিশালী ভূমিকায় আছে।
অন্যদিকে, তুরস্ক আরব আমিরাতের কাছে অনেক দিক দিয়ে একরকম আটকা আছে। যেমন ভু মধ্যসাগরে, ইরাকে, সিরিয়ায়, লিবিয়ায়, আফ্রিকার আরও অনেক দেশে তুরস্কের মুখোমুখি আমিরাতের প্রক্সিরা। একটু ঝামেলা হলেই তাদের দিয়ে হামলা চালাবে তুরস্কের স্বার্থের উপর।
তাই তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্কে ভবিষ্যতে আমিরাতের উপরে চাপ আসার সম্ভবনা কম। অর্থাৎ- আমিরাত তুরস্ক সম্পর্কে, আরব আমিরাত শক্ত অবস্থানে। তাই তুরস্ক একটু নমনীয় হওয়ায় আমিরাত দৌড়ে আসছে সম্পর্ক গড়তে।
আসলে মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি-আমিরাতি জোট তাদের কিছু কৃত্রিম কমন শত্রু তৈরি করে নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক শক্ত করেছিল। অর্থাৎ- তারা তাদের চারিদিকে এমন কিছু কমন সমস্যার সৃষ্টি করেছে যার আল্টিমেট ফলাফল দাঁড়ায় শত্রুর বিরুদ্ধে ঐক্য।
যেমনটি হয়েছে, ইয়েমেন যুদ্ধের শুরুতে, কাতারের বিরুদ্ধে, তুরস্কের বিরুদ্ধে, মুসলিম ব্রাদারহুডের বিরুদ্ধে। এগুলোতে তারা ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করার সিদ্ধান্ত নেয়।
এগুলোর বেশিরভাগই ছিল সৌদির তৈরি সমস্যা। এক্ষেত্রে আসলে আরব আমিরাত মূলত সৌদি আরবের পাশে দাঁড়ায়। যেমন ইয়েমেনের যুদ্ধ মূলত ইরানের বিরুদ্ধে সৌদি আরবের যুদ্ধ।
২০১৫ সালে সৌদি এবং আবু ধাবির যুবরাজরা মিলে ইয়েমেনে ইরান সমর্থিত হুথিদের দমন করতে একটি আরব সামরিক জোট গঠন করে। ২০১৭ সালে কাতারের বিরুদ্ধে যে কূটনৈতিক, বাণিজ্যিক এবং ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে তাও মূলত সৌদি আরবের স্বার্থেই করা একটা অযৌক্তিক অবরোধ।
কিন্তু এসব লড়াইয়ে সৌদি বলয়ে থাকায় আমিরাত আসলে তেমন কিছুই পায়নি। যেমন ইয়েমেন যুদ্ধে কোন সফলতা নেই। ফলে ২০১৯ সালে আমিরাত তাদের সৈন্যদের একটা বড় অংশ তুলে নিয়ে আসে। এতে ক্ষুব্ধ হয় সৌদি আরব।
আমিরাত সেখানে সৌদি বিরোধী একটা গ্রুপকে সমর্থন দিচ্ছে। অন্যদিকে, এবছরের জানুয়ারিতে কাতারের উপর থেকে নিসেধাজ্ঞ তুলে নেয় সৌদি আরব তাতে ক্ষুব্ধ হয় আরব আমিরাত। আবার গত বছর সংযুক্ত আরব আমিরাত ইসরাইলের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করলে সৌদি আরব নাখোশ হয়।
এছাড়াও বহুমুখী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রবর্তন এবং তেলের উপর নির্ভরশীলতা কমাতে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মাদ বিন সালমানের নিয়ে আসেন নতুন এক অর্থনৈতিক পরিকল্পনা যা ভিশন-২০৩০ নামে পরিচত। এই পরিকল্পনা নিয়েও বিপাকে আছে সংযুক্ত আরব আমিরাত।
দুবাইয়ের আদলে সৌদিকে একটি আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করতে চাইছেন এমবিএস। এরই অংশ হিসেবে সৌদি আরব গত ফেব্রুয়ারি মাসে বহুজাতিক সংস্থাগুলোকে উপসাগরীয় এলাকায় তাদের আঞ্চলিক সদরদপ্তরগুলো ২০২৪ সালের ভেতর সৌদি আরবে স্থানান্তর করার আল্টিমেটাম দেয়। তা না করলে সৌদি সরকার ওই কোম্পানি গুলোর সঙ্গে কোন চুক্তি করবে না বলেও জানায়।
ওই এলাকায় ব্যবসা বাণিজ্যের মূল কেন্দ্র দুবাই এই হুমকি ভাল চোখে দেখেনি। তারা এটাকে আমিরাতের ওপর পরোক্ষ একটা হামলা বলেই বিবেচনা করেছে।
সৌদি-আমিরাতের দ্বন্দ্ব যেভাবে প্রকাশ্যে আসে
আমিরাত এবং সৌদি আরবের মধ্যে এই বিবাদ আরও প্রকাশ্যে আসে ওপেক প্লাসের সর্বশেষ বৈঠকে। জুলাইয়ের শুরুতে অনুষ্ঠিত হওয়া ওই বৈঠকে, ওপেক প্লাসের নেতা সৌদি আরব এবং রাশিয়া তেল উৎপাদনের মাত্রা কমিয়ে রাখার প্রস্তাব দিলে সংযুক্ত আরব আমিরাত তা প্রত্যাখ্যান করে। ফলে তাদের আলোচনা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়।
এর প্রতিশোধ নিতে সৌদি আরব তার পর্যটকদের আমিরাতে ভ্রমণ নিষিদ্ধ করে। সেখানে বিমান চলাচল বন্ধ করে দেয়। এছাড়াও সৌদি আরব তাদের পণ্য আমদানি নিয়ে নতুন আইন জারি করে যাতে মূলত আমিরাতি পণ্য সৌদি আরবে ঢোকার পথ সঙ্কীর্ণ করা হয়।
এই সব কিছুই ওই অঞ্চলের ভূ- রাজনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে আসে।যে আমিরাত-সৌদির স্বার্থে তার জোরজুলুমকে সমর্থন দিয়েছে কাতার এবং ইয়েমেনে, সেই আমিরাতকেই এখন ওই অঞ্চলে একঘরে করে রাখার পাঁয়তারা চলছে।
সৌদি আরবের সঙ্গে কাতারের, ইরানের এবং তুরস্কের সম্পর্ক উন্নয়নের যে চেষ্টা চলছে তাতে আমিরাত এক ঘরে হয়ে পড়েছে এবং এমন একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে যাতে আমিরাতকেই উপসাগরীয় অঞ্চলের সব সমস্যার মূল হিসেবে দেখানো হয়।
মধ্য প্রাচ্যের সব ঝামেলার মূলেই যেন এই দেশটি। যদিও কথাটি অনেকাংশে সঠিক কিন্তু পুরোপুরি দায় আমিরাতের না। কারণ বেশিরভাগ সমস্যায় সৌদি যুবরাজের অতি বেশি ক্ষমতার প্রভাব এবং উচ্চাভিলাষী সিদ্ধান্ত অনেকাংশেই দায়ী।
তবে এই সৌদি-আমিরাত-মিশর জোটের মধ্যে তুরস্কবিরোধী অবস্থানের একেবারে শীর্ষে ছিল আমিরাত। তাদের মিডিয়া এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিরা সরাসরি আক্রমণ করতো তুরস্ককে, তুরস্কের নেতৃবৃন্দকে এবং অটোম্যান সুলতানদেরকেও।
এমনকি গত কয়েকমাস আগে দুবাইতে বসে তুর্কি মাফিয়া ডন সেদাত পেকের এরদোগান সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক সমালোচনামূলক অনেকগুলো ভিডিও ছাড়েন ইউটিউবে। সেগুলো পরে আমিরাতি মিডিয়াও ফলাও করে প্রচার করে।
এবং এমন বার্তা দেয় যেন এরদোগানের পতন শুরু হয়েছে। পরবর্তিতে দু’দেশের গোয়েন্দা সংস্থা যোগাযোগ করে। সেদাত পেকেরের মুখ বন্ধ করে। তখনই ধারণা করা হয়েছিল যে দু দেশের সম্পর্কে নতুন মোড় নিতে যাচ্ছে।
আসলে সম্পর্ক উষ্ণ হতে শুরু করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পতনের পরে। তখন থেকেই আরব আমিরাত মূলত কাতার এবং তুরস্কের বিরুদ্ধে তার শক্ত অবস্থান শিথিল করতে থাকে। আমিরাতের রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা আনোয়ার গারগাশ একসময় তার কট্টর তুরস্ক বিরোধী অবস্থান থেকে সরে এসে আঙ্কারার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের কথা বলেন সেই ৪-৫ মাস আগে।
তার পরে চলতে থাকে গোয়েন্দা ও কূটনৈতিক যোগাযোগ। এপ্রিল মাসে দু দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রীরা ফনালাপ করেন। রমজানের শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। এক মাস পরে তুরস্ক আরব আমিরাতে তার রাষ্ট্রদূত প্রেরণ করে। আমিরাতও তুরস্কের ব্যবসায়ীদের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেয়। উভয় দেশের মধ্যে দৈনিক বিমান চলাচল শুরু হয়।
সর্বশেষ গত আগস্ট মাসের শেষ দিকে আমিরাতের প্রধান নিরাপত্তা উপদেস্টা শেখ তাহনুন বিন জায়েদ আল নাহিয়ান তুরস্ক সফরে আসেন। এরদোগানের সঙ্গে দেখা করেন। সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়ে কথা বলেন।
তিনি গোয়েন্দা এবং নিরাপত্তার চেয়ে বরং অর্থনৈতিক এবং বাবসায়িক সম্পর্ক নিয়ে বেশি আলোচনা করেন। সংযুক্ত আরব আমিরাত, তুরস্কে খুব বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ করবে বলেও জানানো হয় সেই বৈঠকের পরে।
এর কয়েকদিন পরে তিনি সফর করেন কাতার সেখান থেকেও আসে অনেক ইতিবাচক বার্তা। তার এই সফরগুলো ব্যবসা এবং বিনিয়োগের ঊর্ধ্বগতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, তিনি হলেন আবুধাবির ক্রাউন প্রিন্সের ছোট ভাই এবং রাজ পরিবারের ব্যবসাবাণিজ্যের একটা উল্লেখযোগ্য অংশের দেখভাল করেন।
আরব আমিরাতের সুপ্রিম কাউন্সিল ফর ফাইনান্স এন্ড একনমিক অ্যাফেয়ার্সেরও বোর্ড সদস্য। Abu Dhabi Developmental Holding Company’র চেয়ারম্যান, First Abu Dhabi ব্যাংকের চেয়ারম্যান, AbuDhabi’র Royal Group এরও চেয়ারম্যান সহ অনেক বড় বড় কোম্পানির প্রধান পদটি তার দখলে।
এখন অনেকেই প্রশ্ন করছেন তুরস্কে আরব আমিরাতের এই বিশাল এবং গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ হবে কোথায় এবং কোন সেক্টরে। খুব সম্ভবত রিয়াল এস্টেট এবং পর্যটন খাতে হবে এই বিনিয়োগ। তাদের বিনিয়োগ আরও হতে পারে ক্যানাল ইস্তানবুল বা অন্য কোন মেগা প্রজেক্টে। হয়তো কাতারের সঙ্গে একত্রে ক্যানাল ইস্তানবুলে বিনিয়োগ করতে পারে আমিরাত। এছাড়াও ছোট ছোট বিনিয়োগ তো আছেই।
আমিরাতের নিরাপত্তা উপদেষ্টার এ সফরের কয়েকদিন দিন পরে এরদোগানের সঙ্গে ফোনালাপ হয় আবুধাবির ক্রাউন প্রিন্স শেখ মোহাম্মাদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ানের সঙ্গে। তারাও ব্যাবসায়িক সম্পর্কের প্রতি জোর দেন। এছাড়াও দ্বিপাক্ষিক এবং আঞ্চলিক সম্পর্ক নিয়েও আলোচনা করেন।
আসলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুরস্ক-কাতার-ইরান জোটের অবস্থান শক্তিশালী হওয়ার কারণে ওই অঞ্চলের অনেকেই এখন এদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করতে চাচ্ছে। অন্যদিকে তুরস্কও তাদের সঙ্গে আচরণের ক্ষেত্রে নমনীয় হচ্ছে এবং বিগত অনেক নীতি থেকেও সরে আসছে।
এখন ইরাইল এবং সিরিয়ার বাসার আল আসাদের সঙ্গেও সম্পর্ক গড়ার জন্য অনেক তোরজোড় চলছে। গোয়েন্দা বিভাগুলো এ নিয়ে অনেক দূর এগিয়েছে। হয়তো কিছু দিনের মধ্যে অফিসিয়াল ঘোষণা আসতে পারে।
যাহোক, এখন প্রশ্ন হচ্ছে তুরস্ক-আমিরাতের এই সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে কোন দেশ কি ধরণের ছাড় দিবে? অথবা কার কি লাভ হবে? এক নম্বর কথা হচ্ছে ঝগড়া বিবাদ বা সম্পর্কচ্ছেদে কারো তেমন বড় কোন লাভ হয় না। তাই সম্পর্ক উন্নয়ন মানেই লাভ। দু’দেশেরই উপকার হয় এতে। এখন এই সম্পর্ক উন্নয়নে কে কতটুকু ছাড় দিবে?
তুরস্ক মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতি তার সমর্থন কমিয়ে দিবে। তুরস্ক থেকে মুসলিম ব্রাদারহুড পরিচালিত কিছু কিছু মিডিয়া বন্ধ করে দিবে অথবা তাদেরকে আরও নমনীয় সম্প্রচারে বাধ্য করবে। ইতিমধ্যে এধরনের অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে আঙ্কারা।
আমিরাত, সৌদি আরব এবং মিশরে মুসলিম ব্রাদারহুডের সদ্যসদ্যের জেল, ফাঁসি বা নির্যাতন নিয়ে তেমন কোন উচ্চবাচ্য করবে না তুরস্ক। আরব দেশেগুলোর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকবে না হয়তো তবে তার প্রভাব কমিয়ে আনবে।
অন্যদিকে আরব আমিরাত, তুরস্ক বিরোধী প্রোপাগান্ডা চালানো বন্ধ করবে। আমিরাতের টাকায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পরিচালিত মিডিয়ায় তুর্কি বিরোধী মিথ্যা খবর প্রচার বন্ধ হবে। তুরস্কে প্রচুর পরিমাণে বিনিয়োগ করবে।
২০১১ সালের থকে তুরস্ক এবং আরব আমিরাতের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলার। সেটা ২০১৮ সালে অর্ধেকেরও নিচে নেমে আসে। তখন এই বাণিজ্যের পরিমাণ হয় ৭ বিলিয়ন ডলার। বর্তমানে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে সাড়ে আট বিলিয়ন ডলারে।
যেখানে তুরস্কের রপতানি ৩ বিলিয়ন ডলার আর আরব আমিরাতের রপ্তানি সাড়ে পাঁচ বিলিয়ন ডলার। গত কয়েক বছর তুরস্ক যে সব দেশে সবচেয়ে বেশি সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করেছে আরব আমিরাত তাদের মধ্যে অন্যতম।
অর্থাৎ রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক খুব খারাপ হলেও বাণিজ্যিক সম্পর্ক কিন্তু চলতেই ছিল। হয়তোবা কিছুটা মন্তর গতিতে। তাই এই বাণিজ্যের পরিমাণ খুব দ্রুত আগের জায়গায় ফিরিয়ে নিতে চাইবে আঙ্কারা এবং আবু ধাবি।
তবে যে বিষয়গুলোর এখনো সমাধান হয়নি তা হলোঃ লিবিয়া এবং সিরিয়াতে দুই দেশের বিপরীত মেরুতে অবস্থানের কী হবে। তারা কি তাদের অবস্থান থেকে সরে আসবে? নাকি এভাবেই চলতে থাকবে? আরব আমিরাত কি ভূমধ্যসাগরে তুর্কি বিরোধী জোট অর্থাৎ গ্রীস, সাইপ্রাস এবং ফ্রান্সের সঙ্গে একই বলয়ে তুরস্কের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে নাকি সেখান থেকে সরে আসবে।
তুরস্ক কি আসলেই মুসলিম ব্রাদারহুডের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিবে নাকি এখন শুধুমাত্র চোখ দেখানো কিছু পদক্ষেপ নিবে? আরব দেশ গুলোর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক না গলিয়ে কতদিন বসে থাকবে তুরস্ক?
এগুলো হয়তো খুব শীঘ্রই স্পষ্ট হবে না। তবে একটা বিষয় খুবই স্পষ্ট তা হলো মধ্যপ্রাচ্যে খেলার গুটিগুলো নতুন করে আবার সাজাতে শুরু করেছে সবাই। আমেরিকার এই অঞ্চল থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়ায় সবাই নিজের মত করে আবার ভাবতে শুরু করেছে।
আর যে সব ইঙ্গিত আসছে তাতে মনে হচ্ছে এই অঞ্চলে পুরোপুরি শান্তি ফিরে না আসলেও হয়তো রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, কূটনৈতিক বৈরিতা এবং অর্থনৈতিক যুদ্ধ কিছুটা হলেও প্রশমিত হবে।
আসলে তুরস্কের আগামী নির্বাচনে এরদোগানের জয়লাভ করতে হলে দেশটির অর্থনীতিকে দ্রুত ঠিক করতে হবে। তা না হলে আগামীর নির্বাচন তার জন্য বয়ে নিয়ে আসতে পারে মহা বিপর্যয়। তাই আরব দেশগুলো এবং ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন ছাড়া অর্থনীতি পুনরুদ্ধার সম্ভব না।
ভিডিওটি দেখতে এখানে ক্লিক করুন